Bangladesh

সব অপরাধ এক জায়গায় এনেছে ব্যাংক

দেশের দুষ্টচক্র তৈরি করছে ব্যাংক খাত। খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচারসহ সব অপরাধ এক জায়গায় নিয়ে আসছে এ খাত। কিন্তু ব্যাংক খাতের সংকট নিয়ে কথা বললে তা সমাধানের পরিবর্তে রাজনীতিবিদরা যে প্রতিক্রিয়া দেখান, তা দুঃখজনক। গতকাল মঙ্গলবার অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজনে দেশের সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

অনুষ্ঠানে দেশের অর্থনীতির তুলনায় এতগুলো ব্যাংক দরকার আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তিনি। এ সময়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন আগামী নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের হলফনামা দেখে বিস্মিত হয়েছি। অনেকেই কোটি টাকার জমি দেখিয়েছেন লাখ টাকায়। তারপরও অনেকের সম্পদ শতগুণ বেড়েছে। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কাজ করা উচিত।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এক প্রোগ্রামে সিপিডি বলেছে, ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অঙ্ক আরও বেশি। এ ব্যাপারে কথা বললে নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। এটি দুঃখজনক। তিনি বলেন, সংকটের সমাধান না করে প্রথমে দুটি প্রশ্ন করা হয়, কে বলেছে এবং কেন বলেছে। এরপরের প্রশ্ন হলো কী বলেছে। অর্থাৎ সমস্যার সমাধান না করে দূরভিসন্ধি খোঁজা হয়। তিনি বলেন, আমাদের দেউলিয়া আইন আছে, কিন্তু সেটি কার্যকর নয়। এটি কার্যকর থাকলে অনেক সমস্যার সমাধান হতো। কোনো এক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আমি রুগ্ণ শিল্প দেখি, কিন্তু একজনও রুগ্ণ শিল্পপতি দেখি না। তিনি বলেন, এই সরকার ক্ষমতা নেওয়ার সময় ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এরপর পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলের পরও তা ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এটি অস্বাভাবিক।

ড. মোস্তাফিজ বলেন, কোনো সন্দেহ নেই, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে রয়েছে। এই চাপ মোকাবিলায় আগামীতে সংস্কার জরুরি। এক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ ব্যাংকের পরিচালকরা ১২ বছর পর্যন্ত পদে থাকতে পারেন। এটি যৌক্তিক নয়। তারমতে, সংস্কার করতে হবে নিজেদের স্বার্থে। এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পালনের জন্য নয়।

সিপিডির বিশেষ ফেলো বলেন, ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল্যস্ফীতি কমার আভাস রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়তে সময় লাগবে। তিনি বলেন, এখানে আর একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। একটি মূল্যস্ফীতি আরেকটি মূল্যস্তর। উদাহরণ স্বরূপ মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ বাড়ল। তার মানে হলো গত বছর যে পণ্যের দাম ছিল ১০০ টাকা। এ বছর হলো ১১০ টাকা। পরের বছর মূল্যস্ফীতি কমে হলো ৮ শতাংশ। তার মানে হলো পণ্যটির দাম দাঁড়াল ১১৮ টাকা। অর্থাৎ আগের দামে আর পণ্যটি আসবে না। ফলে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। তিনি বলেন, মুদ্রার বিনিময় হার এবং সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে। অর্থনীতিকে অবশ্যই আরেকটি ভারসাম্যে যেতে হবে। এটি প্রাথমিক অবস্থায় সবার জন্য কষ্টকর (পেইনফুল) হবে। কিন্তু বাস্তবতা মানতে হবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা আসছে। কিন্তু যুক্তরাষ্টের হয়তো রাজনৈতিক, ভূরাজনৈতিক এবং কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। সেই স্বার্থে তারা কাজ করে। সেখানে তারা কী নিষেধাজ্ঞা দেয় সেটি বলা কঠিন। তারা যেমন নিজেদের স্বার্থে নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে। আবার ভেনেজুয়েলার মতো দেশের সঙ্গে চুক্তিও করতে পারে। এটি তাদের বিষয়। কিন্তু আমাদের নিজেদের স্বার্থেই শ্রম অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত। তারমতে চীন, ভারত, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থে কাজ করে। আমাদেরকে সম্পর্কের ভারসাম্য রেখে কাজ করতে হবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদ দেখে বিস্মিত হয়েছি। যেখানে এক কাঠা জমির দাম এক কোটি টাকা, সেখানে এক লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। তারপরও যদি শতগুণ সম্পদ বাড়ে তাহলে বাস্তব চিত্র কী? হলফনামায় অনেকের সম্পদ কয়েকশগুণ বেড়েছে। কীভাবে এত কম সময়, এতগুণ বাড়ল, তা দেখার বিষয়। যাদের সম্পদ এত বেড়েছে, সরকার ও নিজ দলের এসবের উৎস খোঁজা উচিত। একইসঙ্গে দুদক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাজ হবে তাদের সম্পত্তির উৎস বের করা। এই সম্পত্তি অবৈধ বা দুর্নীতির মাধ্যমে হয়েছে কি না, তা জানা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কারণ রাজনীতিবিদদের বিষয়ে জনগণের সন্দেহ, অনাস্থা থাকলে নির্বাচনের পর তাদের কীভাবে গ্রহণ করবে।

তিনি বলেন, সরকার নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তৈরি পোশাক শিল্পকে এ পর্যায়ে এনেছে। পোশাকের বিশ্বের বাজার ৭০০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ। ৩১ শতাংশ চীনের দখলে। ফলে পোশাকের ক্ষেত্রেও আমাদের বৈচিত্র্য আনতে হবে। এ ছাড়া রপ্তানি বহুমুখীকরণ করার পাশাপাশি নতুন বাজারে যেতে হবে। এজন্য আমাদের আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের চামড়া খাত ও ওষুধ রপ্তানি জোড় দিতে হবে। তারমতে, বিশ্বে ওষুধের বাজার এক ট্রিলিয়ন ডলার। এটাও আমাদের জন্য সম্ভাবনাময়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামে (ইআরএফ) সভাপতি মোহাম্মদ রিফায়েত উল্লাহ মীরধা এবং সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম প্রমুখ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button