Trending

সমুদ্রের বিপদ প্লাস্টিক দূষণ

সাতশ’ প্রজাতির সাগরের প্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব, বেশকিছু প্রাণী এখন প্রায় বিপন্ন : ‘ব্লু-ইকোনমি’র সুফল ব্যাহত বঙ্গোপসাগর উপকূলে প্লাস্টিক বর্জ্যরে ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প পাটজাত সামগ্রীসহ টেকসই সামুদ্রিক পরিবেশ নিশ্চিতের তাগিদ “অপচনশীল প্লাস্টিক-পলিথিনের দূষণে সমুদ্রের পানির সবস্তরেই ডেকে আনছে মারাত্মক সঙ্কট ও বিপদ”

বর্তমানে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরীয় সামুদ্রিক অঞ্চলে অতিমাত্রায় প্লাস্টিক-পলিথিনের দূষণ হচ্ছে। তা ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মারাত্মক এই দূষণের কারণে মূল্যবান মৎস্যসম্পদসহ প্রায় সাতশ’ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এমনকি বেশকিছু প্রাণী এই প্লাস্টিক দূষণের ফলে এখন প্রায় বিপন্ন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) গবেষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে এসসিআইপি প্লাস্টিক প্রকল্পের অধীনে প্লাস্টিকজাত দ্রব্য বা পণ্যসামগ্রীর বিকল্প হিসেবে পাটের লাগসই ব্যবহারের উপযোগিতা নির্ণয়সহ একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ও উপকূলীয় এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্যরে ব্যবহার হ্রাস করে সমুদ্র অঞ্চল ও দেশের অন্যান্য উপকূলীয় এলাকায় টেকসই সামুদ্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দিক-নির্দেশনা পাওয়া সম্ভব হবে। জার্মানির পরিবেশ-প্রকৃতি সংরক্ষণ ও নিউক্লিয়ার নিরাপত্তা বিষয়ক ফেডারেল মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে ‘এসসিআইপি প্লাস্টিক প্রজেক্ট’ শীর্ষক দেশে প্রথমবারের মতো সমুদ্র সংরক্ষণমুখী একটি গবেষণা প্রকল্প। গতকাল সোমবার চুয়েটে ‘টেকসই সামুদ্রিক ভবিষ্যতের জন্য প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ’ বিষয়ক গবেষণা সেমিনার ও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে উপরোক্ত উদ্যোগের কথা প্রকাশিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চুয়েটের ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন পুরকৌশল ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের ডিন, ‘এসসিআইপি প্লাস্টিক প্রজেক্ট’-এর বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. সুদীপ কুমার পাল, প্রফেসর ড. আয়শা আখতার, চুয়েট রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, প্রফেসর ড. সজল চন্দ্র বনিক, প্রফেসর ড. স্বপন কুমার পালিত, প্রকল্পের অন্যতম গবেষক-বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আসিফুল হক, সায়েন্টিফিক ডাইরেক্টও প্রফেসর ড. মোছাম্মাৎ ফারজানা রহমান জুথী।

এদিকে সমুদ্রবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদগণ গভীর উদ্বেগের সাথে বলছেন, বঙ্গোপসাগরে ক্রমাগত দূষণ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বিশেষত প্লাস্টিক ও পলিথিন সামগ্রীর দূষণে গ্রাস করছে সমুদ্রজগত ও এর পরিবেশ-প্রকৃতিকে। অপচনশীল প্লাস্টিক ও পলিথিনের আগ্রাসনে মূল্যবান মাছ-চিংড়িসহ প্রাণিকুল বিপন্ন প্রায়। ক্রমবর্ধমান দূষণের ফলে সমুদ্রের তলদেশে প্লাস্টিক-পলিথিনের পুরো আস্তর পড়ে যাচ্ছে। মৎস্য ও প্রাণিজগতের বিচরণ ও প্রজনন পরিবেশ হচ্ছে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত। এর পরিণতিতে দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের আধার বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র কওে ‘ব্লু-ইকোনমি’ বা ‘নীল অর্থনীতির’ সুফল অর্জন ব্যাহত হচ্ছে।
সমুদ্র ও এর সংলগ্ন উপকূলভাগ জুড়ে পলিথিন, প্লাস্টিকজাতীয় সামগ্রীর ব্যাপক এবং অবাধ ছড়াছড়ি। বোতল, বক্স, শপিংব্যাগ থেকে শুরু করে হরেক রূপে সাগরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে পলিথিন-প্লাস্টিক। সমুদ্রজগতের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে নীরব ঘাতকের মতোই। পলিথিন-প্লাস্টিক শুধু সমুদ্র পরিবেশ দূষণেই সীমিত নয়। স্বাস্থ্যঘাতি বা প্রাণঘাতি হয়ে উঠেছে। সমুদ্র ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানান, বঙ্গোপসাগরে দৈনিক হাজারো টন প্লাস্টিক, রাবার ও পলিথিনের সামগ্রী বা এসবের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। আর সেই প্লাস্টিক, রাবার ও পলিথিনের বর্জ্য কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) খাবারের সঙ্গে গিলে ফেলছে হরেক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুল। সেখান থেকে খাদ্য চেইনে মাছের সাথে খাবার হিসেবেই অজান্তে মানুষের পেটে ঢুকে যাচ্ছে। এই মাছে যুক্ত থাকা প্লাস্টিক ও পলিথিনের কণা বা বর্জ্যাংশ ক্যান্সার, কিডনি বিকল, পাকস্থলীর সংক্রমণসহ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগ-ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ও সমুদ্রবক্ষে যেখানে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যাপক ছড়াছড়ি সেখানে মাছের পেট ও শরীর হয়ে ঘুরেফিরে শেষ গন্তব্য হিসেবে মানুষের পেট ও শরীরেই তা ঢুকে পড়ছে। যা বড় ধরনের বিপদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক অঙ্গসংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক ৮০ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পরিমাণ প্লাস্টিক ও পলিথিন দ্রব্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। বাস্তব পরিমাণ আরো বেশিও হতে পারে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণ প্লাস্টিক-পলিথিন নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এর সঠিক তথ্য নেই। এ অবস্থা চললে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগর-মহাসাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণই বেশি হবে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। প্লাস্টিক-পলিথিনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কমপক্ষে ৬শ’ প্রাণী। এ ক্ষেত্রে ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ এবং এর সংলগ্ন সমুদ্র অঞ্চল। কেননা মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণিকুলের গলায় ও পেটে প্লাস্টিক, পলিথিন বর্জ্য আটকে মারা পড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে বংশ বৃদ্ধি। সী-গালসহ সমুদ্রে বিচরণশীল পাখীরাও হচ্ছে বিপন্ন। পৃথিবীর বিভিন্ন সাগর-উপসাগরের মতো বঙ্গোপসাগর মাছশূন্য হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থ ডে নেটওয়ার্ক-এর প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শীর্ষ প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। অবাধে এমনকি অপ্রয়োজনেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন সামগ্রী। অথচ কেউই ভাবছে না ঘুরেফিরে খাদ্যচক্রে তা মানুষেরই পেটে যাচ্ছে। পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যহানি ঘটছে। সেই সাথে বিপদ ডেকে আনছে সাগরে। মাছের স্বাভাবিক মজুদ ও বংশ বিস্তারে বিপর্যয় ঘটছে।
চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজের সাবেক পরিচালক বিশিষ্ট সমুদ্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. হোসেন জামাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে প্লাস্টিক, রাবার ও পলিথিন বর্জ্য দূষণ সারাবিশে^ আলোচিত এবং আশঙ্কাজনক বিপদের কারণ। সাগরে নিক্ষিপ্ত প্লাস্টিক ও পলিথিন দ্রব্য-সামগ্রী প্রথমে বড় বড় টুকরা হিসেবে ভাসে বা পানির মধ্যে ঝুলে থাকে। এরপর সামুদ্রিক আবহাওয়ায় ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) হিসেবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এসব সামগ্রী ক্রমাগত ছোট হতে হতে প্রসারিত হতে থাকে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণিকুলের খাদ্যচক্রে মাইক্রো-প্লাস্টিকগুলো পেটের পাকস্থলীতে ঢুকে যায়। প্লাস্টিক-পলিথিন বড় সাইজ হলে গলায় আটকে মারা যায়। ক্ষুদ্র হলে মাছেরা গিলে ফেলে। সবচেয়ে বিপদের দিকটি হচ্ছে, আমরা যখন সেই মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীগুলো খাচ্ছি তখন খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিক-পলিথিন মানবদেহে এসে যাচ্ছে। ঘটছে নানাবিধ রোগব্যাধির কারণ।

সমুদ্রের পানির প্রথম, দ্বিতীয়সহ সব লেয়ারেই (স্তরে) প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে দূষণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে করে সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুলের জন্য প্লাস্টিক-পলিথিন বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে। এর সমাধান হলো অবিলম্বে যাবতীয় প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বিকল্প হিসেবে পাটজাত সামগ্রীর ব্যবহার এবং তার ব্যাপক প্রচলন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button