Bangladesh

সরকারকে পাত্তা দিল না চিনি ব্যবসায়ীরা, ‘ভয়ে’ সাবধানী ভোক্তা অধিদপ্তর

“যেহেতু বাজার মাত্র ছয়টি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে, তাই এমন কোনো কাজ করছি না যাতে বাজার থেকে চিনি উঠে যায়,” বলেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক

সরকারকে পাত্তা দিল না চিনি ব্যবসায়ীরা, ‘ভয়ে’ সাবধানী ভোক্তা অধিদপ্তর

বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে পরোয়া না করে বাড়তি দামে চিনি বিক্রি করে যাওয়ার ঘটনায় দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই সরকারের।

অথচ ট্যারিফ কমিশন হিসাব করে দেখেছে, চিনিকল মালিকরা যে দরে বিক্রি করছেন, তাতে তারা অন্তত ১৫ টাকা বেশি মুনাফা করছে।

আবার যে দরে চিনি বিক্রি করার ঘোষণা আছে, বাজারে দর তারচেয়েও বেশি।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মনে করছে, তারা কঠোর হলে বাজার থেকে চিনি ‘উধাও হয়ে যাবে’। তাই তারা তেমন কিছুই করছে না।

গত ১৯ জুন চিনিকল মালিকদের সংগঠন শুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বাণিজ্য সচিবকে চিঠি দিয়ে কেজিপ্রতি ২৫ টাকা দাম বাড়ানোর কথা জানানো হয়।

যেদিন থেকে দাম বাড়ার কথা, সেই ২২ জুন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, তারা ওই প্রস্তাব অনুমোদন করছেন না। দাম কতটা বাড়বে, সেটি তারা ঈদের পর বসে ঠিক করবেন।

চিনির ভ্যাট ও অন্যান্য ট্যারিফ কীভাবে কমানো যায় সেই চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এ বিষয়েও সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।

ঈদ গেছে দুই সপ্তাহ হয়ে গেল, সরকারের বৈঠকের খবর নেই। ওদিকে ঈদের আগেই বাড়তি দামে চিনি বিক্রি শুরু হয়ে যাওয়ায় বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে ভোক্তাদের। 

চিনির বাজার অস্থির বেশ কয়েক মাস ধরেই।

শুক্রবার ঢাকার অন্যতম পাইকারি মার্কেট কারওয়ান বাজারে প্রতিকেজি ১৩৫ টাকায় চিনি পাওয়া গেলেও সেখান থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরের হাতিরপুলে ১৫০ টাকার কমে বেচতে নারাজ মুদি দোকানিরা।

অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিবেচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত ১০ মে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ১২০ টাকা ও প্যাকেটের চিনির দাম ১২৫ টাকা ঘোষণা করেছিলেন। অবশ্য ওই ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রতিকেজি চিনি ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।

বাণিজ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল, তাদের অনুমোদন ছাড়া দাম বাড়ালে বিষয়টি দেখবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

অধিদপ্তর কী করছে, এই প্রশ্নে মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ছয় মাস ধরে চিনির সাপ্লাই চেইনে নানামুখী সমস্যা বিদ্যমান। সেটা ডলার সংকট হতে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাজারে দামে উঠানামা এবং আরও অনেক কিছু। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ হয়ত এই সংকটের সুযোগ নিচ্ছেন।”

বাজারে অভিযান চলছে জানিয়ে সফিকুজ্জামান বলেন, “এইক্ষেত্রে আমরা কোনো অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেহেতু বাজার মাত্র ছয়টি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে, তাই এমন কোনো কাজ করছি না যাতে বাজার থেকে চিনি উঠে যায়।”

চিনির বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের অবস্থান জানতে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ট্যারিফ কমিশন তাদের যে হিসাব পাঠিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, চিনিকল মালিকরা যে মূল্য ঘোষণা করেছেন তা কমিশনের বিবেচনার চেয়েও ১৫ টাকা বেশি।

এই তথ্য জানানোর পর কমিশনের এক কর্মকর্তার কাছে প্রশ্ন ছিল কেন তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানানো সেই কর্মকর্তা বলেন, এটি তার জানা নেই।

চিনির বাজারের এই চিত্র নিয়ে জানতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে কল করা হলেও তিনি ধরেননি।

তবে সম্প্রতি তিনি সংসদে বলেছেন, চাইলে ‘সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে’ ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তবে ‘জনগণের কষ্টের কথা বিবেচনা করে’ তা নেওয়া যায় না সব সময়।

গত ২৮ জুন তার বক্তব্য ছিল, “বাজারে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। এটা ঠিক যে বড় বড় গ্রুপগুলো একসাথে অনেক বেশি ব্যবসা করে। আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার- আমরা জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম। সেটা হয়ত করা সম্ভব।

“কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে, সেটা সইতে তো আমাদের কষ্ট হবে। এজন্য আমরা আলোচনার মাধ্যমে নিয়মের মধ্যে থেকে চেষ্টা করি।”

সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “চিনির দামটা আমি নিজেও উপলব্ধি করি। … স্বীকার করে নিচ্ছি, অনেক সময় বাস্তবায়নটা ধীরগতিতে হয়।”

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মুখপত্র ভোক্তাকণ্ঠের সাবেক সম্পাদক আব্দুল হান্নান মনে করেন, চিনির বাজারকে ছয়টি বড় রিফাইনারির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যারা অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধনের নামে পুরো বাজার দখল করে নিয়েছে।

“এই জায়গাটা এখন পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই অবস্থায় যে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকা দরকার ছিল, সেটা নেই। আবার প্রতিযোগিতা কমিশন প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য যে কাজটি করা দরকার, সেটি করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। সে কারণে সরকার চিনির বাজারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”

ভোজ্যতেল ও চিনির দাম সঠিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয় না দাবি করে হান্নান বলেন, “যেটা করা হয় সেটা পরিশোধনকারীদের বাজার নিয়ন্ত্রণে ও বাড়তি মুনাফা অর্জনে সহায়ক হয়। ট্যারিফ কমিশন আইন অনুযায়ী রিফাইনাররা পৃথকভাবে আমদানি মূল্য ও কতদামে বিক্রি করতে চায় এই দুটি তথ্য ট্যারিফ কমিশনে দাখিল করার কথা। কমিশন তাদের প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আমদানি খরচের ওপর ভিত্তি করে পৃথক পৃথক মূল্য অনুমোদন করার কথা।

“কিন্তু এখন অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে গণহারে গড়ে একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়। সরকার সেই প্রস্তাবের ওপর সিদ্ধান্ত দেয়।  আমরা ভোক্তাদের পক্ষ থেকে বার বার দাবি করে আসছি- এই প্রক্রিয়ায় কোম্পানিগুলোকে বাড়তি মুনাফা করার সুযোগ করে দিচ্ছে। অথচ একেকজনের আমদানি খরচ একেক রকম। এতে সরকারই পরোক্ষভাবে সিন্ডিকেট তৈরি করে দিচ্ছে।“

চিনির বাজারে রিফাইনারদের বিরুদ্ধে আসা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান এবং সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা ধরেননি।

দোকান ভেদে দামে পার্থক্য

হাতিরপুল কাঁচা বাজারে জাকের স্টোরে চিনির দাম কেজিতে ১৫০ টাকা। তবে কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের মুদি দোকান ফারুক স্টোরে ১৩৫ টাকায় বিক্রি করছিলেন আবুল খায়ের।

সকালে জাকের স্টোরে কেনাকাটা করতে আসা রিমন আহমেদের সঙ্গে দাম নিয়ে তর্কে জড়ান বিক্রেতা আবু জাহের।

রিমনের ভাষ্য, “উনি এক লিটার তেল চাইতেছে ২০০ টাকা। আর চিনির দাম বলতেছে ১৫০ টাকা, তাও আবার খোলা চিনি। সবকিছুর দাম যদি খালি বাড়তেই থাকে, তাইলে আমরা কই যাব?”

পরে অবশ্য আবু জাহের তীর ব্র্যান্ডের এক লিটার সয়াবিন তেল ১৯০ টাকায় বিক্রি করেছেন। কিন্তু চিনির দামে ছাড় দেননি।

সরকারকে পাত্তা দিল না চিনি ব্যবসায়ীরা, ‘ভয়ে’ সাবধানী ভোক্তা অধিদপ্তর

দোকানি বলেন, “এতদিন পর কালকে কারওয়ান বাজার থেকে ৫০ কেজি খোলা চিনি আইনা আমরা প্যাকেট করছি। ১৫০ এর নীচে বেচতে পারব না। গত এক সপ্তাহ দোকানে কোনো চিনি উঠাই নাই। কাস্টমার আসলে বাইরের দোকান থেকে আইনা দিছিলাম। আর যখন দিতে পারি নাই, তখন ফিইরা গেছে। এখন শুধু খোলা চিনি আছে।”

একই বাজারের ফারুক স্টোরের দোকানি আবুল খায়ের বলেন, “অনেকদিন হইল চিনিই বেচি না। চিনি ছাড়া সব আছে।”

কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের দোকানি মামুন হোসেন বলেন, “খোলা চিনি আমরা ১৩৫ টাকা কইরা বিক্রি করি, আমাদের কেনা পড়ে ১৩০ টাকা।”

কারওয়ান বাজারের তুলনায় অন্য বাজারে অনেক বেশি দাম নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা তো সরাসরি ডিলারদের থেকে আনতে পারি। কিন্তু এক বস্তা চিনি যে মহল্লায় নেয়, তার কম করে হলেও রিকশা ভাড়া আছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। আর সেগুলারে যখন আড়াইশ গ্রাম বা ৫০০ গ্রামের প্যাকেট করে, তখন তো দামটা আরও বাড়ে।”

কিন্তু এই মার্কেটেই আবার কোনো কোনো দোকানি মহল্লার দোকানগুলোর সমান দাম রাখছেন।

তেমনি একজন হলেন শাহ পরাণ। তিনি বলেন, “খোলা এবং প্যাকেট চিনি, দুইটাই ১৫০ কইরা। খোলা চিনি সর্বনিম্ন ১৪০ রাখতে পারব। আমার কেনা ১৩৭ টাকা।”

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button