Bangladesh

সরকারি চাকরি: বেকারের ব্যয় কমল না, বরং আরও বাড়ল

চাকরিতে আবেদনের ফি কমানোর দাবি অনেক দিনের। সেটা কমেনি; বরং অনলাইন আবেদনে কমিশনের ওপর ভ্যাট বসল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন চাকরির খোঁজ করছেন রাকিবুল ইসলাম। সরকারি বেতনকাঠামোর নবম ধাপের (গ্রেড) একেকটি চাকরিতে তাঁকে আবেদন ফি ও কমিশন দিতে হয় ৬৪০ টাকা।

শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে (টিউশনি) কোনোরকমে রাজধানীর আজিমপুরে একটি মেসে থাকা রাকিবুল প্রথম আলোকে বলছিলেন, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে আবেদন ফি কমানোর দাবি তো মানাই হলো না, বরং সরকার নতুন করে মূল্য সংযোজন করের (মূসক/ভ্যাট) বোঝা বাড়াল।

সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে আবেদন ফি কমানোর দাবিতে বিভিন্ন সময় চাকরিপ্রার্থীরা কর্মসূচি পালন করেছেন। বেকারদের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৬ সালে আবেদন ফি ছাড়াই আবেদনের সুযোগ দেওয়া শুরু করে। তবে অন্য কোনো সরকারি চাকরিতে ফি কখনোই কমানো হয়নি। বরং বেড়েছে। এবার সরকারি চাকরির আবেদনের কমিশনের ওপর ভ্যাট আরোপ করেছে অর্থ বিভাগ।

সরকারের টাকা সংগ্রহ বা আয়ের অনেক উৎস আছে। এই খাত থেকে ভ্যাট না নিয়ে সরকার তরুণদের প্রতি কিছুটা মানবিক আচরণ করতে পারে।

আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ১৭ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, অনলাইনে চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরের কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার হবে ১৫ শতাংশ। সাধারণত অনলাইনে আবেদন করা হয় সরকারি মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমে। নিয়ম হলো, টেলিটক আবেদন ফির সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে নিতে পারবে।

নবম গ্রেডের একটি চাকরির আবেদনে ফি ৬০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে টেলিটকের কমিশন হবে ৬০ টাকা। এই ৬০ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হবে, যার পরিমাণ ৯ টাকা। সব মিলিয়ে চাকরিপ্রার্থীর ব্যয় হবে ৬৬৯ টাকা। ভ্যাট আরোপের আগে বাড়তি ৯ টাকা লাগত না।

বিষয়টি নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ, সাবেক আমলা ও অর্থনীতিবিদদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাঁরা বলছিলেন, একটি চাকরির আবেদনে বাড়তি ৯ টাকা খুব বেশি নয়। তবে প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হলো সরকার কেন রাজস্ব আদায়ের একটি উপায় হিসেবে বেকারদের চাকরির আবেদনকে বেছে নেবে। চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, তাঁদের অনেক চাকরিতে আবেদন করতে হয়। তারপরও চাকরি পাওয়া যায় না। প্রতিবার বাড়তি টাকা দিলে সেটা একেবারে কম দাঁড়ায় না।

যেমন রাকিবুল বলছিলেন, ‘বিভিন্ন দেশে সরকার বেকারদের ভাতা দেয়। আর সরকার আমাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে।

কেন বসল ভ্যাট

চাকরিপ্রার্থী

সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বিশাল বাজেট ঘোষণা করেছে। বাজেটের আকার প্রায় ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। এই বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু আমদানি কমে যাওয়ায় শুল্ক আদায় ততটা বাড়ছে না। আবার অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা ততটা বেশি না থাকায় কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।

সাময়িক হিসাবে সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর, যা লক্ষ্যের চেয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কম। আর এক দশকের মধ্যে রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে গত অর্থবছরে। টাকার অভাবে বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকির টাকা যথাসময়ে দিতে পারছে না সরকার।

বিভিন্ন দেশে সরকার বেকারদের ভাতা দেয়। আর সরকার আমাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে।

রাকিবুল ইসলাম, চাকরিপ্রার্থী

রাজস্ব আদায় বাড়াতে এবং ভর্তুকি কমাতে সরকার কিছু কিছু খাতে কর ও ফি বাড়িয়েছে এবং বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাস, সার ও ন্যায্যমূল্যের চালের দাম। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ৫১টি সেবার মূল্য গত জানুয়ারিতে ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়। সর্বশেষ আরোপ হলো চাকরির আবেদন ফির কমিশনের ওপর ভ্যাট। এতে এখন সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদনকারীদের ব্যয় বাড়বে, বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয়।

সরকার বিভিন্নভাবে করজাল বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি এড়ানো গেলে ভালো হতো। বেকার বা চাকরিপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের কর থেকে রেহাই দেওয়া যেত; তাঁরা তো মাশুল দিচ্ছেনই, মূসক না নিলেও চলত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান

বেকারদের ব্যয় কত

শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে মোট বেকার মানুষের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৩০ হাজার। বেকার জনগোষ্ঠী মূলত তাঁরাই, যাঁরা সর্বশেষ সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কাজ করেননি এবং কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের চূড়ান্ত ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। তাই জানা যায়নি কাদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। তবে সাধারণত শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি থাকে।

সরকারি চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ফি ১০০ টাকা। সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন ফি ৭০০ টাকা। স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরা সাধারণত নবম গ্রেডের চাকরিতে বেশি আবেদন করেন। এই পদের ক্ষেত্রে ফি ৬০০ টাকা। অনেকে দশম থেকে ষোলোতম গ্রেডের চাকরির খোঁজে থাকেন, ফি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা।

কিছু কিছু সরকারি সংস্থা ও কোম্পানিতে চাকরির আবেদন ফি অনেক বেশি নেওয়া হয়, কোথাও ১ হাজার টাকা, কোথাও দেড় হাজার টাকা। যেমন ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডে (ডেসকো) গত বছর ফেব্রুয়ারির এক বিজ্ঞপ্তিতে কয়েকটি আবেদনের ক্ষেত্রে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আবেদন ফি ধরা হয়েছিল।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদের প্রায় ২৬ শতাংশ পদ শূন্য, যা সংখ্যায় প্রায় পাঁচ লাখ। চাকরির বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবছর সরকারি চাকরি ও সরকারি সংস্থায় প্রায় ৫০ হাজার পদের বিপরীতে ৬০ লাখ চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেন।

সরকারি চাকরিতে প্রায় ৬০টি আবেদন করে পরে একটি বেসরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া শান্ত আলী প্রথম আলোকে বলেন, চাকরির আবেদনেই তাঁর ৩০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে ঢাকায় চাকরির পরীক্ষা দিতে যাওয়ার ব্যয় এবং থাকা-খাওয়ার খরচ।

দিনাজপুরের বাসিন্দা শান্ত বলেন, একবার ঢাকায় আসা–যাওয়া করতে বাসভাড়া লাগত দেড় হাজার টাকার মতো। দুদিন সাধারণ মানের হোটেলের ভাড়া দুই হাজার টাকা। একেবারে সাধারণ মানের খাবার খেলেও দুই দিনে ৫০০ টাকা লাগত। তিনি আরও বলেন, পড়াশোনা শেষে পরিবারের কাছে টাকা চাওয়ার অবস্থা থাকে না। আসলে বেকারদের কান্না কেউ দেখে না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদের প্রায় ২৬ শতাংশ পদ শূন্য, যা সংখ্যায় প্রায় পাঁচ লাখ। চাকরির বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবছর সরকারি চাকরি ও সরকারি সংস্থায় প্রায় ৫০ হাজার পদের বিপরীতে ৬০ লাখ চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেন। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েক হাজার পদে নিয়োগের বিপরীতে আবেদনকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২৫ লাখ।

বেকারদের চাকরির আবেদনের কমিশনে ভ্যাট আরোপের বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরিতে আবেদন ফি চাকরিপ্রার্থীদের খরচের বোঝা বাড়িয়ে দেয়। কমিশনের ওপর যদি ভ্যাটও বসে, তাহলে বেকারদের খরচ আরও বেড়ে যাবে। যদি ভ্যাট আরোপ করতেই হয়, তাহলে আবেদন ফি কমিয়ে তা সমন্বয় করা উচিত।

এখন চাকরিতে আবেদনকারী অনেক এবং বেশি আবেদন ফি নেওয়া উচিত নয় উল্লেখ করে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকারের টাকা সংগ্রহ বা আয়ের অনেক উৎস আছে। এই খাত থেকে ভ্যাট না নিয়ে সরকার তরুণদের প্রতি কিছুটা মানবিক আচরণ করতে পারে।

একবার ঢাকায় আসা–যাওয়া করতে বাসভাড়া লাগত দেড় হাজার টাকার মতো। দুদিন সাধারণ মানের হোটেলের ভাড়া দুই হাজার টাকা। একেবারে সাধারণ মানের খাবার খেলেও দুই দিনে ৫০০ টাকা লাগত।

দিনাজপুরের বাসিন্দা শান্ত

দাবি অপূর্ণ, উল্টো ভ্যাট

চাকরিতে আবেদনের ফি কমাতে চাকরিপ্রার্থীরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন ও বর্তমান কিছু শিক্ষার্থী। গত মার্চেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। আন্দোলন করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। সেখানে সরকারি চাকরিতে আবেদনে কমিশনের ওপর ভ্যাট বসানোর সমালোচনা করছেন অনেকে। কেউ কেউ ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও অর্থ পাচারের কথা তুলে ধরে লিখেছেন, এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই বেকারদের কাছ থেকে টাকা নিতে হতো না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বিভিন্নভাবে করজাল বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি এড়ানো গেলে ভালো হতো। বেকার বা চাকরিপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের কর থেকে রেহাই দেওয়া যেত; তাঁরা তো মাশুল দিচ্ছেনই, মূসক না নিলেও চলত।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button