সরকারি ৮৪ হাসপাতালে ৩,৩৩১ যন্ত্রপাতি অচল
সরকারি হাসপাতালে শত শত মেরামতযোগ্য যন্ত্র পড়ে আছে। রোগ পরীক্ষা করাতে মানুষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যান।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেসোন্যান্স ইমেজিং) যন্ত্রটি দুই বছরের বেশি সময় ধরে নষ্ট। যন্ত্রটি নষ্ট থাকায় কিছু রোগের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা সরকারি এই হাসপাতালে হচ্ছে না। রোগ পরীক্ষা করাতে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা রোগীদের নিয়মিতভাবে অন্য হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন।
শরীরের ভেতরের কাঠামো ও অঙ্গের বিস্তারিত প্রতিচ্ছবি দেখার জন্য এমআরআই পরীক্ষা করা হয়। গত ২৮ অক্টোবর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নন্দ দুলাল সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশেষ করে স্নায়ুরোগের চিকিৎসায় এমআরআই পরীক্ষার দরকার হয়। যেসব রোগীর এমআরআই পরীক্ষার দরকার হয়, তাঁদের আমরা অন্য সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিই।’
এসব যন্ত্র বহু বছর ধরে কেনা হচ্ছে। এখন সংখ্যাটি বড় মনে হচ্ছে। সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে সারা দেশের হাসপাতালে সচল, অচল ও অমেরামতযোগ্য যন্ত্রপাতির তালিকা আমরা তৈরি করেছি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম
হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১ হাজার ৩৫০ শয্যার এই হাসপাতালে এমআরআই যন্ত্রসহ ২২টি যন্ত্র বহুদিন ধরে নষ্ট। যন্ত্রগুলো সারানোর জন্য হাসপাতালের পরিচালক একাধিকবার চিঠি দিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আছে, কাজ হয়নি।
ঢাকা শহরসহ সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে বহু যন্ত্র অচল অবস্থায় পড়ে আছে। গত জুলাইয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া যন্ত্রপাতির হিসাবে দেখা যায়, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল ও জেলা পর্যায়সহ মোট ৮৪টি হাসপাতালে ৩ হাজার ৩৩১টি যন্ত্র অচল অবস্থায় পড়ে আছে। মেরামত করলে এসব যন্ত্র কাজে লাগবে। এ ছাড়া ৯৩৩টি যন্ত্র নষ্ট হয়ে আছে, যেগুলো আর মেরামত করা যাবে না।
একাধিক সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ঔষধ ভান্ডার (সিএমএসডি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনার জন্য যতটা আগ্রহী, যন্ত্রপাতি ব্যবহারোপযোগী রাখার ব্যাপারে ততটা নয়। না চাইতেই অনেক হাসপাতালে যন্ত্র পাঠানো হয়। কিন্তু যন্ত্র চালু রাখার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ দেওয়া হয় না, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া হয় না।
গত ২৮ অক্টোবর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অধ্যাপক বলেন, ২০১২ সালে এই প্রতিষ্ঠানে ক্যানসার চিকিৎসার একটি ‘লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর’ যন্ত্র পাঠায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খুলনা মেডিকেল থেকে এই যন্ত্রের কোনো চাহিদা দেওয়া হয়নি। যন্ত্রটির দাম ছিল ১০ কোটি টাকার বেশি। যন্ত্রটি এক দিনের জন্যও ব্যবহার করা যায়নি। যন্ত্রটি বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে।
৮৪টি হাসপাতালে ৩ হাজার ৩৩১টি যন্ত্র অচল অবস্থায় আছে। অর্থাৎ প্রতিটি হাসপাতালে গড়ে ৪০টি যন্ত্র অচল অবস্থায় আছে। অবশ্য সময়মতো ব্যবস্থা নিলে এসব যন্ত্র সচল করা সম্ভব।
এদিন খুলনার ওই যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দামি এই যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে গেছে। আর কোনো দিন ব্যবহার করা যাবে না।
সরকারি হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয়, ব্যবস্থাপনা ও মেরামত করার কেন্দ্রীয় কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। তাই অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব হয়। আবার প্রয়োজনীয় যন্ত্র খুব ছোট ত্রুটির কারণে অব্যবহৃত পড়ে থাকে। কেউ সারানোর উদ্যোগ নেয় না। সমস্যাটি পুরোনো।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গতকাল শনিবার বলেন, ‘এসব যন্ত্র বহু বছর ধরে কেনা হচ্ছে। এখন সংখ্যাটি বড় মনে হচ্ছে। সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে সারা দেশের হাসপাতালে সচল, অচল ও অমেরামতযোগ্য যন্ত্রপাতির তালিকা আমরা তৈরি করেছি। পাশাপাশি আমরা সাড়ে তিন হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিয়েছি। তাঁরা যন্ত্রপাতি ঠিক করবেন। তখন আশা করি, অচল হয়ে যন্ত্রপাতি কম পড়ে থাকবে। অন্যদিকে আমরা যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
যন্ত্রপাতির হিসাব
এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সেবা ব্যবস্থাপনা শাখা থেকে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে চিঠি দিয়ে যানবাহন ও ভারী যন্ত্রপাতির তথ্য নির্ধারিত ছকে পাঠাতে বলা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো ১৩টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১১টি বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং ৬০টি জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল নির্ধারিত ছকে ভারী যন্ত্রপাতির তথ্য পাঠিয়েছে। তাতে অ্যাম্বুলেন্স, জিপ, পিকআপ, এক্স-রে যন্ত্র, ইসিজি যন্ত্র, আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র, অস্ত্রোপচারের জন্য ওটি টেবিল, ওটি লাইট (সিলিং), ওটি লাইট (পর্টেবেল), ডায়াথার্মি যন্ত্র, সাকার যন্ত্র, অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র, অটোক্লেভ যন্ত্র, ডেন্টাল যন্ত্র, অক্সিজেন সিলিন্ডার যন্ত্র, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র, নেবুলাইজার যন্ত্র, এনজিওগ্রাম যন্ত্র, এমআরআই যন্ত্র ও সিটি স্ক্যান যন্ত্রের তথ্য আছে। এসব যানবাহন ও যন্ত্রপাতি ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাঠানো হয়। মোট কতগুলো যানবাহন ও যন্ত্র পাঠানো হয়েছে, কয়টি সচল আছে, কয়টি অচল ও মোরামতযোগ্য এবং কয়টি অচল ও অমেরামতযোগ্য, ছকে তা পৃথকভাবে দেওয়া আছে।
তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ওই সময়ের মধ্যে ৮৪টি প্রতিষ্ঠানে ৩০৬টি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৫৫টি অ্যাম্বুলেন্স বর্তমানে অচল অবস্থায় আছে। এ ছাড়া ৪৬টি অ্যাম্বুলেন্স আর কোনো দিন ব্যবহার করা যাবে না।
এত বছরে হাসপাতালগুলোতে মোট ৩৩ হাজার ৪৫৬টি যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৯ হাজার ১৯৫টি বা ৮৭ শতাংশ যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে।
৮৪টি হাসপাতালে ৩ হাজার ৩৩১টি যন্ত্র অচল অবস্থায় আছে। অর্থাৎ প্রতিটি হাসপাতালে গড়ে ৪০টি যন্ত্র অচল অবস্থায় আছে। অবশ্য সময়মতো ব্যবস্থা নিলে এসব যন্ত্র সচল করা সম্ভব। অন্যদিকে হাসপাতালগুলোতে একেবারে ব্যবহার–অনুপযোগী যন্ত্র আছে ৯৩৩টি। এসব যন্ত্র মেরামতেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিটি হাসপাতালে এ রকম যন্ত্র আছে ১১টি।
৮০০ কোটি টাকার যন্ত্র অচল পড়ে আছে
যে ১৭ ধরনের ভারী যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসার সরঞ্জাম হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দাম অক্সিজেন সিলিন্ডারের। হাসপাতাল ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রতিটির দাম গড়ে ১৭ হাজার টাকা। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া গেলেও এগুলোর দামে খুব একটা হেরফের নেই।
তবে কিছু যন্ত্র কোম্পানি ভেদে বা কোন দেশে তৈরি, তার ওপর ভিত্তি করে দামে হেরফের হয়। বাজারে ২ লাখ টাকার ওটি টেবিল আছে, আবার ১৪ লাখ টাকার ওটি টেবিলও আছে। অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র ৮ লাখ টাকায় পাওয়া যায়, আবার ২০ লাখ টাকারও অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র সরবরাহ করা হয়।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সাধারণভাবে যেসব যন্ত্রপাতি ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো কোম্পানির তৈরি, সেগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। চীনা কোম্পানির তৈরি যন্ত্রপাতির দাম কম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি হাসপাতালে চীনা কোম্পানির তৈরি যন্ত্রপাতির সরবরাহ বেড়েছে।
১৯৯৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সরবরাহ করা ১৭ ধরনের যন্ত্রপাতির দামের সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দামের গড় থেকে একটি হিসাব পাওয়া যেতে পারে। সেই হিসাবে একটি এনেসথেসিয়া যন্ত্রের দাম ১৪ লাখ টাকা। এভাবে নষ্ট থাকা ১৫৭টি অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্রের দাম ধরা হয়েছে ২১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
এভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, ৮৪টি হাসপাতালে অচল থাকা ৩ হাজার ৩৩১টি যন্ত্রের দাম ৮০০ কোটি টাকার ওপর। ঠিক সময়ে মেরামত না করলে অনেক যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাবে।
অবশ্য সারা দেশে ছয় শতাধিক সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে কত যন্ত্র অচল, তার হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী করছে
সাধারণত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সেবা শাখা থেকে সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়। যা পাঠানো হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ বছর অচল যন্ত্রের তালিকা তৈরির পাশাপাশি নতুন যন্ত্রও হাসপাতালগুলোতে পাঠাচ্ছে সেবা শাখা। ২০২৩ সালের শুরু থেকে গত ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ১৭ ধরনের মোট ৩২৯টি যন্ত্র এসব হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিটি হাসপাতালে মাত্র চারটি করে যন্ত্র পাঠানো হয়েছে।
এ ছাড়া বেশ কিছু যন্ত্র সিএমএসডির গুদামে আছে। গুদামে থাকা যন্ত্রপাতির যে তালিকা পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, অন্য যন্ত্রপাতির সঙ্গে এ ধরনের আরও ২২৮টি ভারী যন্ত্র সরবরাহের অপেক্ষায় আছে।
সঠিক চিকিৎসার জন্য যথাযথভাবে রোগনির্ণয় দরকার। সঠিকভাবে রোগনির্ণয়ের জন্য মানসম্মত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার। কিন্তু সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে যথেষ্টসংখ্যক যন্ত্রপাতি নেই। এই ৮৪টি হাসপাতালের চারপাশে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। দরিদ্র রোগীরা সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে না পেরে নিয়মিতভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য হন। রাজধানীসহ প্রতিটি জেলা শহরে এটি সাধারণ দৃশ্য।
প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্যে মানুষের নিজস্ব ব্যয় বেশি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের হিসাবে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে, প্রায় ৬৫ শতাংশ। আর রোগ পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ব্যয় প্রায় ১২ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার একটি প্রধান কারণ রোগনির্ণয় ব্যয় বেশি। সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকলে এটা হতো না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অজ্ঞতা, অদক্ষতা, অমনোযোগ ও অবহেলার কারণে অসংখ্য যন্ত্র পড়ে থাকে; আর সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন সাধারণ মানুষ।