সরকার বিরোধী দল একাকার
আগামী সপ্তাহে শেষ হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশন পর্ব। আগামী বছর জানুয়ারি পর্যন্ত এ সংসদের মেয়াদ রয়েছে। তবে সংবিধান অনুযায়ী মেয়াদ পূর্তি তিন মাস আগে থেকেই কার্যক্রমগুলো বন্ধ থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ অধিবেশন এবং সংসদীয় কমিটিসহ সংসদ কার্যক্রম দেশের প্রাণকেন্দ্র। বিশেষ করে সংসদ অধিবেশন চলাকালে সারা দেশের মানুষের মূল কেন্দ্র থাকে সংসদের দিকে। কিন্তু এবার জাতীয় সংসদে অধিবেশনের প্রতি আগ্রহ কমতে কমতে এখন শূন্যের কোঠায় নেমেছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদে কদাচিৎ বিরোধী দলের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেছে। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং সরকারি দল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বিপুল সমালোচনা ও আপত্তির পর কখনো কখনো দু-একটি বিষয়ে বিরোধী দলকে কথা বলতে দেখা গেছে। বিশেষ করে সংসদের বাইরে বড় রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপির মাত্র সাত সদস্য যখন সংসদে ছিলেন, তখন মনে হয়েছে সংসদের সত্যিকারের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সরকারি দল। বিএনপির সদস্যদের বক্তব্যের জবাব দিতে দেখা গেছে জাতীয় পার্টির সদস্যদের।
একাদশ সংসদের চলতি অধিবেশনসহ ২৫টি অধিবেশনেই জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখা যায়নি। বরং বিএনপির সাত এমপি পদত্যাগ করার আগে অল্প সময় পেলেও তারা কিছুটা সংসদকে আলোচনা রেখেছেন। গত বছর ডিসেম্বরের শুরুর দিকে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপির সাত সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করার পর অধিবেশন আরও নীরব হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং দুর্বল জাতীয় পার্টির কারণে একাদশ সংসদ বিরোধী দলের ভূমিকা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি দুই শীর্ষ নেতা দেবর-ভাবি তথা গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধ থাকায় দলটির সংসদীয় পার্টিতে ও অভ্যন্তরীণ সংকট ছিল। ফলে জাতীয় পার্টিকে সবসময়ই সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হয়েছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক নাজমুল হাসান কলিমউল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। সংসদে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হলেও আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাত সংসদ সদস্যই মূলত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে গত বছর ১১ ডিসেম্বর তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ করার পর সংসদে একেবারেই নিরস হয়ে যায়। বিএনপি সদস্যরা সংসদে থাকাবস্থায় সরকারের বিভিন্ন নীতি ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে সমালোচনা করেছেন এবং সংসদ থেকে তারা ওয়াক আউট করেছেন। কার্যত জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধী দল হলেও বিভিন্ন বিলের ওপর আলোচনায় তাদের প্রস্তাবগুলো না হলেও ওয়াক আউটের মতো ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে দুয়েকবার।
তিনি আরও বলেন, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় কমই স্থান পেয়েছে সংসদ অধিবেশনে। সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বিরোধী দলের বক্তব্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য ভালো কিছু নয়।
জানা গেছে, জাতীয় পার্টি নিজেও সংসদে তাদের বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে ভেতরে ভেতরে সন্তুষ্ট নয়। ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক সংসদে নিজেই বলেছিলেন, ‘সরকারের কথা বলতে গিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে, স্পিকার, পাবলিক আমাদের আওয়ামী লীগের দালাল বলে।’
জাপা সূত্রে জানা গেছে, চলতি অধিবেশন পর্যন্তই দলটির নেতাকর্মীরা সংসদে জাপার ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন চাপে জিএম কাদের সংসদের বাইরে সরকারের সমালোচনা করলেও অধিবেশনে নীরব থেকেছেন।
জাপা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রতিনিধিরা বলছেন, জাতীয় পার্টি আসলে নামমাত্র সংসদের বিরোধী দল। এটি আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের মতোই কাজ করছে। জাতীয় পার্টির শক্তিশালী ভূমিকা রাখলে সংসদ এতটা প্রাণহীন হতো না। আর এর জন্য সরকার পক্ষের চাপ না যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নিজেদের স্বার্থ।
তবে গত সপ্তাহে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, জাতীয় পার্টির সদস্যরা সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখছে এবং তারা আইন প্রণয়ন কার্যাবলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে। জাতীয় পার্টির সংসদে জনগণের কথা বলছে। সংসদে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও প্রকৃত বিরোধী দল না থাকায় জনগণে প্রত্যাশা পূরণে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। কোরাম সংকটের কারণে ৮৯ দশমিক ২৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, আইন প্রণয়ন ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হলো সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদের বড় দুটি কাজ। গত পাঁচ বছরে এ দুটি ক্ষেত্রেই একাদশ জাতীয় সংসদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। গুরুত্বপূর্ণ অনেক আইন প্রণয়ন হয়েছে এবং বিরোধী দল আলোচনা করেছেন কিন্তু সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেনি। সরকার যেভাবে চেয়েছে আইন সেভাবেই হয়েছে।
গত বছর ১০ এপ্রিল সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদেরের একটি বক্তব্যেই উঠে এসেছে আইন প্রণয়নে বিরোধী দল কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ সংসদ সদস্য বলেছিলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়নে বৈধতা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে সক্ষম নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এবারের সংসদ ছিল পুরোপুরি সরকারি দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির সাত সদস্য থাকলেও বিশাল সমুদ্রের কাছে তারা এক ফোঁটা শিশিরের মতো ছিল। তারপরও কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আসল প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি একেবারে গৃহপালিত হয়েছিল সরকারের প্রতি। এটা সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়েছে।