Bangladesh

‘সরকার যে দাম দেয় এটার কোনো মূল্য নাই’

সেপ্টেম্বর মাসে সরকার যখন দেশের ইতিহাসে প্রথমবার ডিম-আলু-পেঁয়াজের মতো কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারিত করে, তখন সেটি যেমন অনেককে আশান্বিত করেছিল, তেমনি এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশের লোকেরও অভাব ছিল না। আর এরপর মাস পার না হতেই সংশয় যেন সত্যি মনে হচ্ছে।

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি পিস ডিমের দাম কোনোভাবেই ১২ টাকার বেশি হবে না। অথচ ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের এখন ডিম কিনতেই খরচ পড়ছে ১২ টাকার উপর।

বৃহস্পতিবার বাজারে দেখা যায়, প্রতি ডজন ডিম কিনতে ক্রেতাদের খরচ হচ্ছে ১৬০ টাকার মতো। আলুর বাজারেও একই অবস্থা। সরকারের ৩৫ টাকা কেজি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া আলুর সর্বনিম্ন মূল্য এখন ৫০ টাকা।

আলুর যখন হাফ-সেঞ্চুরি তখন সেঞ্চুরির পথে পেঁয়াজ। সরকারের ঠিক করে দেয় দেশী পেঁয়াজের বিক্রয়মূল্য হবে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা, কিন্তু এখন তা ৯০ টাকা ছাড়িয়েছে।

ক্রেতা, বিক্রেতা এবং বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের দাম নির্ধারণ করে ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার‘ চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি সরকারের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরও মনে করে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন আছে।

‘সরকারের ব্যর্থতাই প্রমাণিত‘
বাড্ডায় এক জেনারেল স্টোরের মালিক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘সরকার যে দাম দেয় এটার কোন মূল্য নাই, কারণ এটা কখনোই মিলে না, তারা এটা কার্যকর করতে পারে না। তাই শুধু শুধু এই রেট দিয়ে মানুষের কাছে সরকারের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয়।’

তার দোকানেই বাজার করছিলেন হাসিনা আরা রসুল। তিনি বলেন, সরকারের দাম বেধে দেবার ওপর আর কোনো বিশ্বাস নাই।

তিনি আরো বলেন, ‘সরকার বলে দাম কমবে, কিন্তু তার কোনো ভাব নেই, বরং বেড়ে যাচ্ছে। আগে যা কিনতাম তার থেকে অনেক কম কিনতে হয় এখন।’

বাজারে বেশিরভাগ ক্রেতা-বিক্রেতার কন্ঠে একই সুর। আর বর্তমান পরিস্থিতি এই দু’পক্ষের মধ্যে সম্পর্কটাকেও করে তুলেছে তিক্ত।

বাড্ডা এলাকার আরেক দোকানদার মেহেদী হাসান বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বাড়তি, ফলে মানুষের সাথে ঝগড়া হয়, কাস্টমার ফেরত চলে যায়, কিন্তু কিছু করার নাই, ব্যবসা করে যেন আরো বিপদে পড়ছি।’

তিনি বলেন, পেঁয়াজের দাম গত এক মাসে কয়েক ধাপে বেড়েছে। পাঁচ টাকা, সাত টাকা, দুই টাকা করে বাড়তে বাড়তে সেটি ৭৫ থেকে ৮০ হয়ে এখন ৯২ টাকায় চলে গেছে।

একই এলাকার আরেক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী জানান, ডিমের অবস্থাও তাই। গত প্রায় মাসখানেক ধরেই একবার পাঁচ টাকা কমে তো পরক্ষণেই আবার ১০ টাকা বাড়ে।

বাজারে এই মুহূর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে কেবল তেলের দামেই যা একটু নাগাল দেখা গেল। প্রতি লিটার ১৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন। চিনির দামও কেজিতে তিন টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৩২ টাকায়।

এছাড়া প্রায় সব পণ্যেরই দাম বাড়তি দেখা যায়।

গৃহিণী আনজুম আরা বেগম বাজার করতে এসে অভিযোগ করেন, ‘একেকদিন একেক দাম, কোনোদিন পাঁচ টাকা কমে তো কোনোদিন আবার পাঁচ টাকা বাড়ে। বড়লোকরা তো খাইতে পারতেছে কিন্তু যারা দিন আনে দিন খায় তারা পারতেছে না।‘

ভোক্তা অধিকার কী বলছে?
মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) ডিম, আলু ও পেঁয়াজ এই তিন পণ্যের নির্ধারিত দাম ঘোষণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। কৃষি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে এ দাম নির্ধারণ করা হয়। এই দামের বিষয়টি বাজারে তদারকি ও বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেয়া হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরকে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমরা কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছি, নিয়মিত অভিযান, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি কার্যক্রমের পাশাপাশি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়ার পর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার বেড়ে গিয়েছে।’

তবে এই দাম বেধে দেয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে তার। তিনি মনে করেন, এককভাবে কাজ করলে এতে ফল পাওয়া যাবে না।

‘ডিম যে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় উৎপাদন পর্যায়ে সাড়ে ১০ টাকা ঠিক করে দিল, আর খুচরা পর্যায়ে ১২ টাকা, কিন্তু পরে তো উৎপাদন পর্যায়েই সাড়ে ১১টা বিক্রি হচ্ছে, সেটা তো তাদের দেখভাল করার কথা।’

সফিকুজ্জামান বলেন, কৃষি বিপণন অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে, আলু-পেঁয়াজের যথেষ্ট উৎপাদন হয়েছে, কিন্তু তাহলে এত ঘাটতি হলো কেন?

তিনি মনে করেন, উৎপাদন বেশি হলে দাম এত বাড়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে দেরি হওয়া দাম বৃদ্ধির একটা কারণ।

‘কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো, আবার ভারত থেকেও যথেষ্ট পেঁয়াজ আসছে কিন্তু বাজার তো নিয়ন্ত্রণে নেই।’ এক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব আছে বলে মনে করেন তিনি।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কথায় একইসাথে নিজেদের লোকবল সঙ্কট ও আইনি বাধ্যবাধকতার কথাও উঠে আসে। ‘আমাদের ১৭টি জেলায় কোনো অফিসার নেই। সেখানে আমরা প্রতিটি জেলায় কাজ করার চেষ্টা করছি স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে। এখন দেশী পেঁয়াজ কৃষকরা বাজারে এনে বিক্রি করছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে, সেটা তো ঢাকায় এসে সেঞ্চুরি করবেই। আমরা তো আর কৃষককে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারি না।’

সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমি নিজে হিমাগারে গিয়ে ধরলাম যে আলু রেখে দিয়েছে তাকে পুলিশে হস্তান্তর করলাম, কিন্তু এরপর যদি এদের বিরুদ্ধে মামলা করা না যায় তাহলে তো এই সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না।’

আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার মনে করে বিপণন ব্যবস্থাও ঢেলে সাজানো উচিত। উৎপাদন থেকে খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি হাতবদলে দামের যে বড় পরিবর্তন ঘটানো হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রকৃত ডকুমেন্ট রাখার কথা বলেন তিনি।

‘সামনে ডিমান্ড এবং সাপ্লাই নিশ্চিত করতে না পারলে বাজার যেকোন দিকে যেতে পারে। কোনো পণ্যের সঙ্কট হলেই ব্যবসায়ীদের সেটার সুযোগ নেয়ার মানসিকতা বদলাতে হবে।’

সফিকুজ্জামান বলেন, ব্যবসায়ীদের অতিরিক্তি মুনাফার চিন্তা না করে নিজেদের দায়িত্ব বোধ থেকে এগিয়ে আসা উচিত।

ডিম-আলু-পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করেও তা কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদফতরের কেউই কথা বলতে রাজি হননি।

সমস্যা চাহিদা ও জোগানে?
বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে সবচেয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ।

অর্থনীতিবিদ আসাদুজ্জামান মনে করেন, চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভরশীল জিনিসের দাম বেধে দিলে তা খুব বেশি কাজে আসে না।

যেমন আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখা যায় কিন্তু কাঁচা মরিচ তো রাখা যায় না, তাহলে এটার কেনো এত দাম বাড়লো। তাহলে সমস্যাটা উৎপাদনে, কিন্তু সেটা কেউ বলে না।’

অর্থনীতিবিদ আসাদুজ্জামান বলেন, উৎপাদন যে কোনটার আসলে কত, সেটার কোনো সঠিক হিসাব নেই, একটার সাথে আরেকটা মিলে না। এ কারণেই দাম বেধে দিলে তা কোনো কাজে আসছে না, কারণ সমস্যাগুলো থেকেই যাচ্ছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার আরেকটা কারণ হিসেবে এই অর্থনীতিবিদ তুলে আনেন মূল্যস্ফীতির সময় নতুন টাকা সরবরাহের বিষয়টি।

আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা হয়েছে আগুনে ঘি ঢালার মতো। যখন সবকিছুর দাম বাড়তি, সরকারও স্বীকার করছে, সে সময় মানি সাপ্লাই ছিল সুইসাইডাল।‘

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button