সরকার সহায়তা না করলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়
- সংস্কারের জন্য সময় দিতে হবে
- প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে
- গত তিন নির্বাচন যারা প্রহসনে পরিণত করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা যায় ভাবতে হবে
সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পরই নির্বাচনী রোডম্যাপ হওয়া উচিত বলে মনে করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচন নিয়ে যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো করব, আমাদের ধারণা এই প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকার বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে। তার থেকে কতগুলো বিষয় নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছবে। ওই প্রক্রিয়ায় নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি হবে।’
শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, প্রার্থী ও নাগরিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক ছায়া সংসদে (বিতর্ক) আলোচনায় এসব কথা বলেন ড. বদিউল আলম। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘কোনো কোনো সংস্কারের ব্যাপারে তারা একমত হবে, সেসব সংস্কার করতে কত সময় লাগবে এবং সেই সংস্কারগুলো সরকার ও নির্বাচন কমিশন কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, এসব বিবেচনা করেই নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি হওয়া যৌক্তিক।’
নির্বাচন কমিশন কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের খুব বড় চ্যালেঞ্জ নাই। যেটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেখেছি অতীতে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। আমাদের অতীতের নির্বাচন কমিশনগুলো বলছে তারা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করে নাই। তাদের ওপর বিভিন্ন পক্ষ থেকে চাপ ছিল। সেই চাপ এবার থাকবে না বলে মনে করি। সবচেয়ে বড় যে ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ সেটা অনুপস্থিত।’
তারপরও নির্বাচন কমিশনের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন বদিউল আলম। তিনি বলেন, ‘যতগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভোটার তালিকা সুষ্ঠু করতে হবে। ভোটার তালিকায় কিছু কিছু অসঙ্গতি আছে। বড় অসঙ্গতি হলো মেয়েদের সংখ্যা কমে গেছে। ২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, তখন ১৪ লাখের মতো বেশি নারী ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এবার কিন্তু পুরুষের তুলনায় নারী ২৩-২৪ লাখের মতো কম। যদিও নারীরা আমাদের জনসংখ্যায় কিছুটা বেশি। কিন্তু আমাদের জেন্ডার গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে ভোটার তালিকায়। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। যাতে সবাই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।’
প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘প্রবাসে দেড় থেকে দুই কোটি অথবা তারও বেশি ভোটার রয়েছে। তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণই নয় এটা নির্বাচন কমিশনের বড় দায়িত্ব। এটা সহজ বিষয় নয়। এদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, এদের এনআইডি দেওয়া এগুলো চ্যালেঞ্জের কাজ।’
সংস্কারের বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘স্বৈরাচারী ব্যবস্থা তো আকাশ থেকে পড়ে নাই। এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ। আমাদের যে প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এর মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে, এই পদ্ধতি-প্রক্রিয়া পরিবর্তন দরকার। তা না হলে আবারও সেই পুরনো অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। এ জন্যই কতগুলো সংস্কার দরকার।’
বদিউল আলম বলেন, ‘২০০৭-০৮ সালে সংস্কারের কথা ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তখন সংস্কারবাদী বলে তকমা লাগানো হয়েছে অনেকের বুকে। তখন সংস্কার একটা গালিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সেখানে মাইনাস টু’র কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওটা বাদ দিলেও যদি ওই সংস্কারগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়ন হতো তাহলে হয়তোবা যে পরিস্থিতিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে পালাতে হয়েছিল, সে পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। তবে আমি নিশ্চিত নই। কিছু কিছু সংস্কার, কিছু কিছু পরিবর্তন, শুধু পদ্ধতি-প্রক্রিয়াই নয় আচরণগত পরিবর্তনও আনতে হবে।’
সংস্কারের জন্য সময় দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের যে স্বর্গরাজ্যে আমাদের দেশ পরিণত হয়েছিল, পদ্ধতি প্রক্রিয়া যদি সঠিক হতো তাহলে এগুলো করে তারা পার পেয়ে যেতে পারত না। সংস্কারটা গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কারের জন্য কিছু সময় দিতে হবে। যৌক্তিক সময় দিতে হবে। যাতে অতীতের অভিজ্ঞতা ফিরে না আসে।’
বিগত তিনটি নির্বাচন যারা প্রহসনে পরিণত করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম বলেন, ‘যারা নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। যারা সাংবিধানিক পদে থেকে নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে, প্রহসনে পরিণত করেছে, তাদের কী শাস্তি হবে সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে। কী আইনে, কী বিধানে, কোন পদ্ধতিতে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায় সেটা ভাবার বিষয় রয়েছে।’
এনআইডি হালনাগাদ থাকলে ভোটার তালিকার প্রয়োজন হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এনআইডি যদি সঠিক হয় জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা যেতে পারে।’
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন আয়োজন করা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছেন, নির্বাচনের ট্রেনযাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। কিন্তু এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে তা জনগণ জানতে পারলে ভালো হয়।’
নির্বাচন বিলম্বিত হলে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এজন্য নির্বাচনী ট্রেনের যাত্রা শুরু হওয়ার পাশাপাশি সরকারকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব বাড়লে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে পারে।’ আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি ১০ দফা সুপারিশ করে।
‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের চেয়ে প্রার্থীসহ জনগণের ভূমিকাই বেশি’ শীর্ষক ছায়া সংসদে কবি নজরুল সরকারি কলেজের বিতার্কিকদের পরাজিত করে তেজগাঁও কলেজের বিতার্কিকরা বিজয়ী হন। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র দেওয়া হয়।