Bangladesh

সরবরাহকারীদের মূল্য পরিশোধের বিলম্বে গ্যাস সংকট আরও তীব্র হচ্ছে

মূল্য পরিশোধ বকেয়া থাকায় কিছু এলএনজি সরবরাহকারীও এখন নতুন চালান দিতে চাইছে না…

চলমান ডলার সংকটের মধ্যে স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানির বিল পরিশোধ দেরী হচ্ছে। তাতে করে, হ্রাস পেয়েছে এলএনজি সরবরাহ। এ পরিস্থিতিতে, আরেকটি গ্যাস সংকটের মধ্যে পড়েছে – শিল্প কারখানা থেকে শুরু করে আবাসিক গ্রাহক।

ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও অস্থিতিশীল মুদ্রাবাজারের কারণে যখন ভোক্তাচাহিদা কমছে, এবং সিমেন্ট, ইস্পাত ও পোশাক খাতসহ প্রায় সকল শিল্পই যখন তাতে জর্জরিত – তারমধ্যেই দেখা দিল এ সংকট।

স্থানীয় বাজার-নির্ভর শিল্পের পাশাপাশি বিশ্ববাজার-নির্ভর উদ্যোগগুলোর জন্যও বড় প্রতিকূলতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এই গ্যাস সংকট।  

তীব্র গ্যাস সংকটের এই প্রভাব শুধু ব্যবসাবাণিজ্যেই নয়, পড়ছে আবাসিক গ্রাহকের ওপরও। অনেক বাসাবাড়িতেই জ্বলছে না গ্যাসের চুলা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোর সামনে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি দীর্ঘতর হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী, সরবরাহ করতে হিমশিম দশা ফিলিং স্টেশনগুলোর।

এদিকে আগামী ১ নভেম্বর থেকে দেশের একটি বা দুটি রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এক্সিলারেট) রক্ষণাবেক্ষণ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে, যা চলবে অন্তত দুই মাস। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণ কাজের ফলে গ্যাসের এ সংকট আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত থাকতে পারে।

তবে আসন্ন শীতের মাসগুলোয় গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় চাহিদা কমলে, বিদ্যমান সরবরাহ দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইনস) প্রকৌ. কামরুজ্জামান খান বলেন, স্পট মার্কেট থেকে আমদানি  বাড়াতে না পারায় এবং নতুন একটি সার কারখানায় উৎপাদন চালু হওয়ায়– সবাইকে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

‘তাছাড়া, আমরা রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করব। কাজ শেষ হওয়ার আগে সরবরাহ স্বাভাবিক করা কঠিন।’

শিল্প কারখানায় সরবরাহ ব্যাহত

গত তিন ধরে চট্টগ্রামে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট বা প্রায় ১২ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। এতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে তৈরি পোশাক খাত।

গ্যাসের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায় ছোট-বড় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বিকল্প জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন চালু রেখেছে। এতে জ্বালানি খাতে তাদের ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে তৈরি পোশাকের উৎপাদন কমে গেছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিজিএমইএ)-র ভাইস চেয়ারম্যান রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ক্রিসমাস বা বড়দিন উপলক্ষে প্রস্তুত করা পোশাকগুলোর এখন ফিনিশিং এর কাজ চলছে। কয়েকদিনের মধ্যে এসব পণ্যের শিপমেন্ট শিডিউল রয়েছে। ‘কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে কারখানায় গত তিন দিন ধরে কাজ বন্ধ। উৎপাদন এভাবে আরও ব্যাহত হলে চরম সংকটে পড়ে যাব।’

বিজিএমইএ-র একজন পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল আজম বলেন, ‘গ্যাসের প্রেশার কম থাকলে পোশাক পণ্যের কালার কোয়ালিটি নষ্ট হয়ে যায়। তখন বাধ্য হয়ে বিকল্প জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন চালু রাখতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। চট্টগ্রামের গ্যাস সংকট দীর্ঘ হলে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে টেক্সটাইল খাতের ব্যবসায়ীরা।’

দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাতপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান- বিএসআরএম এর দুটি কারখানায় দৈনিক রড উৎপাদনের সক্ষমতা সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন। চারটি বিলেট কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৬ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি।

প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, কাঁচামাল সংকটের কারণে এমনিতেই উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে– কম উৎপাদন হচ্ছে। গ্যাস সংকটে যা আরো কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বিএসআরএম গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তপন সেন গুপ্ত বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন চালু রাখতে ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে গ্যাসের তুলনায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় তিনগুণ। গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হতে থাকলে– আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।

গ্যাস-নির্ভর শিল্পের মধ্যে অন্যতম সিরামিকস শিল্প। সাধারণত কারখানায় গ্যাসের চাপ ১২ পিএসআই প্রয়োজন হলেও– এখন পিক আওয়ারে তা ৪-৫ পিএসআইয়ে নেমে আসে বলে জানান উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশই হয় গ্যাসের মূল্য পরিশোধে। পণ্য প্রস্তুত করতে চুল্লিতে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহ থাকতে হয়। গ্যাসের চাপ কমে গেলে চুল্লির অভ্যন্তরে উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় থাকা সব পণ্য তাৎক্ষণিকভাবে নষ্ট হয়ে যায়।

‘বন্ধ চুল্লি চালু করতে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে। অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণে সময়মতো পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করছে। স্থানীয় বাজারেও সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। উৎপাদন বন্ধের পাশাপাশি যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়াও উদ্বেগের কারণ’- যোগ করেন তিনি।  

প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, ‘গ্যাসের প্রেশার ওঠানামার কারণে কারখানার যন্ত্রপাতি ফল্ট করার আশঙ্কা থাকে।’

আবাসিক সংযোগেও গ্যাসের চাপ কম

ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের আবাসিক গ্যাহকরাও ঠিকমতো সরবরাহ পাচ্ছেন না।  বিশেষত, ভোর পাঁচটার পর থেকেই কমে যাচ্ছে গ্যাসের চাপ।

যে চাপ থাকে, তাতে চুলা জ্বলে নিভু নিভু করে, ফলে রান্না করা যায় না। মঙ্গলবার রাজধানীর সচিবালয় সেগুনবাগিচায় গ্যাসের অভাবে রান্না করতে পারেনি অনেক পরিবার।

একইভাবে রাজধানীর- মোহাম্মদপুর, পান্থপথ, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, মিরপুর, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মান্ডা ও বাড্ডা থেকে গ্যাস-সংকটের বিষয়ে অভিযোগ আসছে বেশি বলে জানা গেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জরুরি অভিযোগ কেন্দ্র সূত্রে।

গত তিন দিন ধরে অব্যাহত গ্যাস সংকটে বাসার রান্না নিয়ে চরম বিপাকে চট্টগ্রামের বাসিন্দারাও।

চট্টগ্রাম নগরীর রঙ্গিপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাধুরী মমতাজ বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে চরম অস্বস্তিতে আছি। গ্যাসের প্রেশার কম থাকায় রান্নাঘরেই দিনের বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আমিনুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। শনিবার থেকে আমরা পাচ্ছি ২৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে সরবরাহ ঠিক রাখা যাচ্ছে না।

আমদানি মূল্য পরিশোধে বিলম্ব যেভাবে গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত করছে

চলতি মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত, জাতীয় সঞ্চালন গ্রিডে গ্যাসের মোট সরবরাহ ছিল দৈনিক ২,৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এসেছে এলএনজি অংশ থেকে।   

তবে স্পট বাজারের চালান থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় – গত সপ্তাহ থেকে সঞ্চালন গ্রিডেও গ্যাসের মোট সরবরাহ কমতে শুরু করে।

গত ২৩ অক্টোবর দৈনিক মোট সরবরাহের পরিমাণ নেমে আসে ২,৬৬৩ মিলিয়ন ঘনফুটে, যেখানে এলএনজির অংশ ছিল ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

এলএনজি আমদানিতে জড়িত রাষ্ট্রায়ত্ত একটি প্রতিষ্ঠান– রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, চলতি মাসের শুরুতে মাত্র এক কার্গো এলএনজি পাওয়া গেছে।

চাহিদা মেটাতে এই মাসে তারা আরও চালান আমদানি করবেন কিনা– সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাতে পারেননি।  

এলএনজি আমদানিতে ওমান ও কাতারের সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। নিয়মিত এ সরবরাহের বাইরে স্পট মার্কেট বা খোলা বাজার থেকেও এলএনজির দুই থেকে তিনটি কার্গো আমদানি করা হয়।  

জাতীয় গ্রিডে দৈনিক প্রায় ৩,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ নিশ্চিত করতে স্পট মার্কেট ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি – উভয় উৎস থেকে – পেট্রোবাংলা ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান দিত।

কিন্তু, ডলার সংকটে আমদানির মূল্য পরিশোধে সমস্যা দেখা দেওয়ায় কর্তৃপক্ষটি স্পট মার্কেটের অংশ কমাচ্ছে।  

রাষ্ট্রায়ত্ত তেল, গ্যাস ও খনিজ কর্পোরেশনটির কর্মকর্তারা জানান, গত ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহকারীদের কাছে পেট্রোবাংলার মূল্য পরিশোধ বকেয়া ছিল ১৫০ মিলিয়ন ডলার।  

এছাড়া, শেভরনসহ স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদনে জড়িত আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো ২১৯ মিলিয়ন ডলার পাবে পেট্রোবাংলার কাছে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে, পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইনস) প্রকৌ. কামরুজ্জামান খান বলেন, শেভরন ও তাল্লো’র মতোন আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোসহ দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট মার্কেটের এলএনজি সরবরাহকারীরা পাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ।

‘এ অবস্থায়, স্পট বাজারের অনেক এলএনজি সরবরাহকারীই এখন আর চালান দিতে চাইছে না’- যোগ করেন তিনি।  

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor