Bangladesh

সরবরাহ লাইন না করেই ওয়াসার প্রকল্প চালু, ক্ষতি ৭১০ কোটি টাকা: পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্প

ঢাকা ওয়াসা রীতিমতো ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি’ জুড়ে দিয়েছে পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পে। সেখানে সরবরাহ লাইন তৈরির কোনো আয়োজন না করেই চালু করা হয়েছে কার্যক্রম। ফলে সক্ষমতার অর্ধেকের কম পানি উৎপাদন করায় ৫৬ মাসে ঢাকা ওয়াসার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭১০ কোটি টাকা। কারণ এই প্রকল্পের দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ৪৫ কোটি লিটার। আর এ সময়ে দৈনিক উৎপাদনের গড় ২০ কোটি লিটার। অর্থাৎ ২৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন কম হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহক সংখ্যা এবং পানির দামের নির্ধারিত মূল্য হিসাব-নিকাশ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

এমন পরিস্থিতি হওয়ার পরও সরবরাহ লাইন স্থাপনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই ঢাকা ওয়াসার। কয়েক দফা প্রকল্প গ্রহণের আওয়াজ তুললেও বাস্তবতা হচ্ছে এখনো কোনো প্রকল্পের অনুমোদন মেলেনি। অথচ মূল প্রকল্পের অনুষঙ্গ হিসাবে সরবরাহ লাইন রাখা দরকার ছিল। রহস্যজনক কারণে তা রাখেনি কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় চুক্তির শর্ত মোতাবেক ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষে আগামী মাস থেকেই চায়নার সুদের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে।

এছাড়া এ প্রকল্প ঘিরে শুরু থেকেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অনিয়ম চিহ্নিত করতে অনুসন্ধান শুরু করে। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদও করে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেটি আর বেশিদূর এগোয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের পানি বিক্রি করে বছরে গড় আয় দাঁড়াবে প্রায় ১৩০.৭১ কোটি টাকা। আর সুদসহ চায়নার কিস্তি পরিশোধ করতে হবে বছরে ৩০৮.৬৩ কোটি টাকা। পাশাপাশি বার্ষিক গড় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় দাঁড়াবে ৮০.৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে ঢাকা ওয়াসার এই প্রকল্পে ভর্তুকি দিতে হবে ২৫৮.৩২ কোটি টাকা। সরবরাহ লাইন করে উৎপাদন সক্ষমতা না বাড়ালে দীর্ঘসময় ধরে ঢাকা ওয়াসাকে এই ভর্তুকি বহন করতে হবে। যেটা মূলত পানির দাম বাড়িয়ে নগরবাসীর কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করা হবে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না সিএমএসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড ২০১৪ সালে পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শুরু করে ২০১৯ সালের জুনে ঢাকা ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করে। চুক্তি মোতাবেক এই প্রকল্প থেকে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের কথা। ঢাকা ওয়াসার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের জুলাই কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি চালু করতে পারেনি। ওই বছরের পহেলা অক্টোবর প্রকল্পটি চালু হলেও ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন পানি উৎপাদন হয়েছে ৫.৫৬ কোটি লিটার। চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের এমন গুরুতর ঘটনার পরও ঢাকা ওয়াসা ঠিকাদারকে চূড়ান্ত বিল পরিশোধ করেছে। শুধু তাই নয়, এক বছরের ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যে প্রকল্পের যে কোনো সমস্যা নিজ অর্থে সম্পাদনের লিখিত চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে দিয়ে তা না করিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০৫ কোটি টাকা খরচ করেছে।

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, পদ্মা নদীর পানি শোধন করে ঢাকায় পানি সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর একনেক এই প্রকল্প অনুমোদন করে। প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ২৯০.৮০ মিলিয়ন ডলার ২.৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয় চায়না এক্সিম ব্যাংক। অর্থাৎ টাকায় চায়না সুদের বর্তমান আকার ৩ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার অঙ্কে বেশি পরিমাণ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে।

আরও জানা গেছে, ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রতিদিনের উৎপাদন প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়-এই সময়ে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার করে পানি উৎপাদন হলে মোট উৎপাদন হওয়ার কথা ৭৬ হাজার ৬৮০ কোটি লিটার। অথচ এই সময়ে উৎপাদন হয়েছে ৩৫ হাজার ৮৬২ কোটি লিটার। এ সময়ের উৎপাদন ঘাটতির পরিমাণ ৪১ হাজার ২১৮ কোটি লিটার। অথচ একই রক্ষণাবেক্ষণ খরচে সমপরিমাণ পানি উৎপাদন করা সম্ভব ছিল।

অনুসন্ধানে পাওয়া ঢাকা ওয়াসার নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকল্পটি পূর্ণ সক্ষমতায় না চলার কারণে আবাসিক বিলে ক্ষতি হয়েছে ৫৩১.৩০ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক বিলে ক্ষতি হয়েছে ১৭৪.৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্পটি চালুর পর উৎপাদন অক্ষমতায় ঢাকা ওয়াসার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৭১০ কোটি টাকা।

আরও দেখা যায়, প্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী-প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ৬৫ কোটি টাকার মধ্যে থাকার কথা থাকলেও নথিতে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর গত ৫ অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের গড় ধরা হয়েছে ৮০.৪০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত পানি বিক্রি করে মোট আয় হয়েছে ৬১০ কোটি টাকা। অথচ রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয়েছে ৪০২ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসার আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহক এবং দাম ধরে র‌্যানডম স্যাম্পলিং পদ্ধতিতে হিসাব বের করা হয়েছে।

প্রকল্পের পদে পদে দুর্নীতি : প্রকল্পের শুরু থেকে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উদ্যোগী হয়েও রহস্যজনক কারণে তদন্ত করেনি। যার ফলশ্রুতিতে দেশকে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক খেসারত দিতে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

আরও জানা গেছে, পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের পদ্মা নদী থেকে ঢাকা পর্যন্ত ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩ কিলোমিটারের পাইপলাইন বসানো হয়েছে। সেখানে ২০০০ মিলিমিটার ব্যাসের ডাকটাইল আয়রন পাইপ ধরা আছে। কিন্তু ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে অত্যন্ত নিম্নমানের, কম পুরুত্বের, কম দামের পাইপ কেনা হয়। চায়না থেকে ঠিকাদারের পাঠানো নিম্নমানের পাইপ গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় তৎকালীন প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে যখন প্রকল্পটি পরীক্ষামূলক চালু করার জন্য ইনটেক পয়েন্টের ৫টি পাম্প চালু করা হয়, তখন মূল সঞ্চালন লাইনের দুটি স্থান ফেটে যায়। প্ল্যান্টের ভেতর অনেক ত্রুটি দেখা দেয়। সেই দিনই ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হয়ে যায় যে, এই প্ল্যান্টটি কখনো পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো সম্ভব হবে না। এজন্য মাত্র ২০০ কোটি টাকার পানি সরবরাহ লাইন নির্মাণে ঢাকা ওয়াসা অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছে। পাইপ কেনার দুর্নীতি নিয়ে দুদক তদন্তে নামলেও অদৃশ্য চাপে ২০১৫ সালের ১৪ জুন তদন্তের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগকে দেওয়া হয়। যা আর আলোর মুখ দেখেনি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বারবার নিজস্ব তহবিলের টাকায় সরবরাহ লাইন করতে বলা হয়। কিন্তু তিনি প্রতিবারই অনাগ্রহ দেখান। তখন আমি বুঝে নিয়েছি পানি শোধনাগারটি পূর্ণমাত্রায় পানি উৎপাদনে অক্ষম। এ ব্যর্থতার দায় পানির দাম বাড়িয়ে জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপ-প্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এমএ মোস্তফা তারেকের সহযোগিতা চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। যুগান্তরকে জানান, এটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বিরাগভাজন হতে পারেন।

এ বিষয়ে পদ্মা (যশলদিয়া) প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে যেসব অনুষঙ্গ ধরা ছিল সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই বা আমি সংশ্লিষ্ট নই।

তিনি বলেন, প্রকল্পের শুরুতে সরবরাহ লাইন ধরা ছিল না। তবে সরবরাহ লাইন হওয়া দরকার। কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে কাজ করছে। আর প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষের পর ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ড শেষে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সে হিসাবে হয়তো আগামী মাস থেকে ঢাকা ওয়াসা তা পরিশোধ করবে।

এ সম্পর্কে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম সহিদ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্প চালু হওয়ার পর প্রথম দিনে সরবরাহ লাইনের নানা ত্রুটি থাকায় ৫ থেকে ৭ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হয়েছে। আর এখন দৈনিক ২৫ থেকে ২৬ কোটি লিটার উৎপাদন হচ্ছে। চালুর পর থেকে গড় হিসাব করলে উৎপাদন গড় কম হবে।

তিনি বলেন, সরবরাহ লাইন না থাকায় পানি শোধনাগার প্রকল্পের সক্ষমতার পুরোপুরি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ সরবরাহ লাইন তৈরির কাজ করছে। যতটুকু জেনেছি সরবরাহ লাইন নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব সরকার অনুমোদন করেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d