Hot

সর্বত্রই সিন্ডিকেট সক্রিয়

পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই :: সরকারকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে -জোনায়েদ সাকি :: সবখানে সিন্ডিকেট আগের মতোই সক্রিয়, শুধু আওয়ামী লীগের স্থলে অন্য দল সে জায়গা দখল করেছে -ভিপি নুর :: বাজারে সিন্ডিকেট এখনো আছে, হাত বদলের মাধ্যমে বাড়ছে দাম -মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলেও অন্য কোন কিছুরই এখনো পরিবর্তন হয়নি। পাঁচ মাস হলো শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছে। অথচ এখনো সর্বত্রই তার রেখে যাওয়া সিন্ডিকেট সক্রিয় আছে। নিত্যপণ্যের বাজার, পরিবহন সেক্টর, প্রশাসনসহ সর্বত্র চলছে আগের মতই। ৫ আগস্টে পট-পরিবর্তনের পর শুধু সিন্ডিকেটের হোতাদের অর্থাৎ সদস্যদের পরিবর্তন হয়েছে, সিন্ডিকেট এখনো অটুট রয়েছে। আগে সিন্ডিকেটের সদস্য ছিল আওয়ামী লীগের নেতারা আর এখন তাদের জায়গায় এসেছে বিএনপি বা অন্যদলের নামধারী নতুন মুখ। পরিবর্তন শুধু এ টুকুই। এসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। সরকার নিরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। বাজার সিন্ডিকেটের কারণে আমনের ভরা মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম। অথচ ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিশ্ব বাজারে চালের দাম কমেছে। চিনির দামও বিশ্ব বাজারে কমেছে। অথচ এদেশের বাজারে এর কোন প্রতিফলন নেই। চিনির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল খাদ্যপণ্যের দামও বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে। অন্যদিকে মৎস্য ও পোল্ট্রি খাদ্যের দামও বিশ্ব বাজারে কমলেও সিন্ডিকেটের কারণে দেশের বাজারে আগের মতই আছে। আর এর ফলে কমছে না ডিম, মুরগী ও মাছের দাম।

বর্তমান সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার নিজেও সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। রাজধানীর খামার বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বাজারের সিন্ডিকেট এখনো আছে। হাত বদলের মাধ্যমে দাম বাড়ছে, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি তা নিয়ন্ত্রণের।’ কিন্তু তাদের এ চেষ্টা কার্যত নিষ্ফল বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আর এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। একটি সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর মানুষের মনে যে প্রত্যাশার জন্ম নিয়েছিল তা এখন হতাশায় পর্যবসিত হচ্ছে। চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপণ্যর ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে মানুষের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। এর থেকে যেন কিছুতেই মুক্তি মিলছে না।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ইনকিলাবকে বলেন, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে যে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা এ সরকার করতে পারছে না। প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি তার এক ভাষণে এ বিষয়টি উল্লেখও করেছেন। বাজার, পরিবহনসহ সবখানে এখনো সেই চাঁদাবাজি চলছে। আওয়ামী লীগের জায়গায় অন্যান্য দল এসেছে। এই চাঁদাবাজির কাঠামো গত পরিবর্তনের জন্য যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা নেয়া হচ্ছে না। পুলিশ এখনো নিষ্ক্রিয়। তারা সেই পুরানো পথেই হাঁটছে। এসব বিষয় নিয়ে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, শেখ হাসিনা ও তার দোসররা পালিয়ে যাওয়ার পর নতুন মাফিয়ারা এখন বিভিন্ন সিন্ডিকেটের সদস্য হয়েছে। আওয়ামী লীগের জায়গায় এখন অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজি করছে। পরিবহন সেক্টরে সেই আগের মতই নৈরাজ্য-চাঁদাবাজি চলছে। প্রশাসনে এখনো হাসিনার দোসররা সক্রিয়। বাজার সিন্ডিকেটও আগের মতই সক্রিয়। শুধু আওয়ামী লীগের স্থলে অন্য দল সে জায়গা দখল করেছে। এর বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের যে কঠিন ও কঠোর ভূমিকা নেয়া দরকার ছিল তা তারা পারছে না। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে হলে, গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের যে প্রত্যাশা তা পূরণ করতে হলে সরকারকে আরও কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৫৮ জন কর্মকর্তার নেতৃত্বে দেশব্যাপী অভিযান শুরু করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। তাতে বাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় বলে জানান কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক কষ্টে আছে। অনেকে কম খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু নানা সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে তারা মাঝখান থেকে দাম বাড়িয়ে মুনাফা করছে বিভিন্ন পণ্যে। এখানে উৎপাদকরা তেমন কিছু পাচ্ছেন না। সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না। প্রতিযোগিতা কমিশনের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত সাধারণ চাল ও কর্পোরেট চালে ২০টি, ভোজ্য তেলে ৯টি, ডিম নিয়ে কারসাজি করায় ১৭টি, মুরগী সিন্ডিকেট ৯টি, পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একটিসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ১২০টি মামলা করেছে। তারপরও সিন্ডিকেটের কারসাজি কমছে না।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, আমরা বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের এক অংশকে চিহ্নিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বগ্রহণের সময় মুখে অনেক বড় বড় কথা বলেছে। মানুষকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছে। পরিবহনের চাঁদাবাজি বন্ধ করে সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিত্যপণ্যের মূল্য অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে এমন বক্তব্যও উপদেষ্টাদের অনেকে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের এ বক্তব্য শুধু কথার কথা বলেই মানুষের কাছে মনে হচ্ছে। বাজারের সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয়। বাজার ব্যবস্থাপনা আগের মতই রয়েছে। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। সব মধ্যস্বত্বভোগীরা এখনো ভোগ করছে। বর্তমানে শীতকালীন সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি এসব কৃষকরা ২ টাকা থেকে ৩ টাকা পিস বিক্রি করছেন। অনেকে পশুকে এসব সবজি খাওয়াচ্ছেন। অথচ ঢাকায় এসব সবজি এখনো প্রতি পিস ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে এসব সবজির দাম তিনশ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। বাজারের এই অব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের কারণে ডিম, মুরগী, দুধ এসব পণ্যেরও ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না প্রান্তিক খামারিরা। সিন্ডিকেট ও কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের মধ্যেও দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত লাভ করছে। সিন্ডিকেটের সদস্য কে বা কারা এটি বর্তমান সরকারও জানে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বা নিতে পারছে না। ক’দিন আগে ভোজ্য তেলের সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে বাজারকে অস্থির করে তোলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রোজার আগেই তেলের দাম বাড়ানো। শেষ পর্যন্ত তারা সেটা করেছে। সরকার এই সিন্ডিকেটের কাছে নতি স্বীকার করে তেলের দাম রাতারাতি লিটারে ৮ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে।

গত নভেম্বরে ডিমের ডজন ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা হয়েছিল। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভারত থেকে ডিম আমদানি করা হয়। অভিযানও চালানো হয়। ন্যায্য মূল্যে ডিম বিতরণ করা হয়। তারপর ডিমের ডজন বর্তমানে ১৪০ টাকায় নেমে এসেছে। সরকার গত ১৫ অক্টোবর ডিমের যে দাম বেঁধে দিয়েছিল, তাতে এক ডজন ডিমের দাম কোনোভাবেই ১৪৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। বর্তমানে এর কাছাকাছি দামে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের ও মুরগীর দাম আরও কমানো সম্ভব বলে মনে করেন খামারিরা। তারা মনে করেন পোল্ট্রি ফিডের মূল্য যদি কমানো হয় তাহলে ডিম ও মুরগীর দাম আরও কমবে। পোল্ট্রি ফিডের বাজার সিন্ডিকেট মুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) একটি সমীক্ষা বলছে, এক দিন বয়সী মুরগীর বাচ্চা, মুরগীর খাবার ও ডিমের দাম ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। ডিম উৎপাদনের জন্য খামারিদের এক দিন বয়সী মুরগীর বাচ্চা কিনে লালন-পালন করতে হয়। গত মাসে ভারতে এক দিন বয়সী মুরগীর বাচ্চার দাম ছিল প্রতিটি ৩৫ থেকে ৫৫ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ২১ থেকে ৪২ টাকা। বাংলাদেশে মুরগীর বাচ্চার দাম ৫৫ থেকে ৭৪ টাকা। অর্থাৎ, বাংলাদেশে মুরগীর বাচ্চার গড় দাম ভারতের চেয়ে ৪২ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ১০৫ শতাংশ বেশি। একশ্রেণীর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কারসাজির মাধ্যমে এভাবে অধিক মুনাফা অর্জন করছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি মো. আহসানুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, পোলট্রি খাদ্যের মূল উপকরণ ভুট্টা, সয়াবিন ইত্যাদি ভারত ও পাকিস্তান অনেকটাই উৎপাদন করে। বাংলাদেশকে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যয় বেশি। তিনি বলেন, আমদানিতে জাহাজভাড়া ও অগ্রিম আয়কর বাবদ ব্যয়ও আছে। সরকার পোলট্রি শিল্পকে এগিয়ে নেয়া এবং ডিম ও মুরগী সাশ্রয়ী করতে খাদ্যের উপকরণ আমদানি শুল্কমুক্ত রেখেছে। তাতে মানুষ কতটা সুফল পাচ্ছে, সেই প্রশ্নও রয়েছে।

ক্ষুদ্র খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার ইনকিলাবকে বলেন, ভারতে যে ডিমের উৎপাদন খরচ প্রতিটি ৫ টাকার আশপাশে, বাংলাদেশে সেটা সাড়ে ১০ টাকা কেন হবে। ব্রয়লার মুরগীর উৎপাদন খরচ ভারতে ৮২ টাকা, বাংলাদেশে তা কেন ১৭০ টাকা হবে। এর কারণ, পোলট্রি খাদ্যের দাম। তিনি বলেন, পোলট্রি খাদ্যশিল্পে ‘সিন্ডিকেট’ (অসাধু জোট) রয়েছে। সেই ‘সিন্ডিকেটের’ সঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। এ অভিযোগের বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, আমাদের কোনো কর্মকর্তা সিন্ডিকেট বা কোনো ধরনের যোগসাজশের সঙ্গে জড়িত নন। অবশ্য সুমন হাওলাদার বলছেন, সাদিক অ্যাগ্রোর সঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের যোগসাজশ আলোচিত ছাগলকা-ের পর বেরিয়ে এসেছে। তদন্ত করলে পোলট্রি খাদ্য উৎপাদনকারীদের সঙ্গে যোগসাজশও বের হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d