Hot

সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে গ্যাস উৎপাদন, সংকট প্রকট

  • দৈনিক চাহিদা ৪১০ কোটি ঘনফুট, সরবরাহ ২২৫ কোটি ঘনফুট
  • এলএনজি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় চেষ্টা হলেও অর্থসংকট ও কারিগরি ত্রুটিতে সাফল্য আসেনি

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। উন্নত দেশ গড়ার রূপকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। উন্নত দেশ গড়ার পথে প্রধান শর্তগুলোর একটি শিল্পের উন্নয়ন। কিন্তু শিল্পের বিকাশ এবং বিদ্যমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য যে পরিমাণ জ্বালানি দরকার তা উৎপাদন ও সরবরাহে পিছিয়ে পড়ছে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সংস্থাগুলো। এমনকি দেশের শিল্প ও বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদনও গত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গ্যাস অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগ না নেওয়া, আর্থিক সংকটে এলএনজি আমদানি বাড়াতে না পারা এবং নিয়মিত বিরতিতে কারিগরি ত্রুটি ও পরিচালনগত অদক্ষতার কারণে দেশে গ্যাসের ঘাটতি দূর হচ্ছে না বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা। গ্যাসের উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ ঘাটতি বাড়ায় দেশে গ্যাস-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিল্পের চাকা থেমে গেছে বা ধীর হয়ে গেছে। গাড়িতে সিএনজি না পেয়ে বিপাকে গাড়ির মালিক, চালক ও যাত্রীরা। অনেক বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বা দিনের কিছু অংশে ঢিমেতালে জ্বালানো যায় রান্নার চুলা। 

দেশে শিল্পের উন্নয়ন, আর্থিক প্রবৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবে জ্বালানি গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে। গ্যাস অনুসন্ধান, উৎপাদন এবং আমদানির মিশ্রণে এ চাহিদা মেটানোর পরিকল্পনা এক যুগের বেশি সময় আগে করেছে সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের সংস্থান করতে গ্যাসের দামও বেড়েছে দফায় দফায়। কিন্তু সেগুলো সময়মতো বাস্তবায়িত না হওয়ায় এখন গ্যাস-সংকট পিছু ছাড়ছে না। টাকা খরচ করেও মিলছে না গ্যাস।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে দৈনিক ৪১০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে আমদানিসহ ৩১০ থেকে ৩২৫ কোটি গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির। এ পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করলে মোটামুটিভাবে ঘাটতি ব্যবস্থাপনা করতে পারে গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলো। নতুন সংযোগ নিয়ন্ত্রণ এবং অপেক্ষাকৃত কম চাপে গ্যাস সরবরাহ করে গ্রাহকদের চাহিদাও অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে ঘাটতি থাকলেও তা বড় সংকট হিসেবে দেখা দেয় না।

তবে আর্থিক সংকটের কারণে গত দুই বছর ধরে আমদানিও কমাতে হচ্ছে। এর মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণজনিত জটিলতা, পরিচালনগত অদক্ষতা ও দুর্ঘটনা এবং কারিগরি ত্রুটির কারণে প্রতি বছরেরই একটি বড় সময় জুড়ে আমদানি ও সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। যা ভোগান্তি বাড়ায় গ্রাহকদের, ক্ষতিগ্রস্ত করে শিল্পকে এবং নিরুপায় করে তোলে অল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে একটি এলএনজি টার্মিনাল এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অপারেশনে নেই। গত ৯ জুলাই কর্ণফুলী টানেল ও কাফকোর মাঝামাঝি জায়গায় এক দুর্ঘটনায় ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা দিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে এলএনজি সরবরাহ করা হয়।

পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২০১ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। এর বাইরে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে প্রায় ২৪ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। এই আমদানিকৃত গ্যাসসহ সব মিলিয়ে প্রায় ২২৫ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন দেখানো হয়। অথচ স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২০১২ সালে দৈনিক গড়ে ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। যা এখনকার স্থানীয় উৎপাদনের চেয়ে বেশি। আর ২০১৫ সালে দৈনিক গড়ে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্পাদিত হতো। এটি সাম্প্রতিক উৎপাদিত ও আমদানিকৃত মোট গ্যাসের পরিমাণের চেয়ে বেশি।

দেশে ২০১৮ সালে প্রথম গ্যাস আমদানি করা হয়। ঐ বছরের আগস্টে কক্সবাজারের মহেশখালীতে পেট্রোবাংলার ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে আমদানিকৃত এই জ্বালানি যুক্ত হয়। পরের বছর ২০১৯ সালের এপ্রিলে সামিট গ্রুপের এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। দুই টার্মিনাল দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রাখে। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে যৌথ পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহারের নজির খুব কমই রয়েছে। আর গ্যাসের চাহিদা মেটানোর টেকসই ও সাশ্রয়ী সমাধান হলো স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান করে উৎপাদন বাড়ানো। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল এবং সমুদ্রাঞ্চলে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে এখন পর্যন্ত অর্জন শূন্য। বঙ্গোপসাগরে খনিজ-জ্বালানি অনুসন্ধানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে পেট্রোবাংলা।

জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোতে উত্তোলনযোগ্য প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুত রয়েছে ২৮ দশমিক ৮৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে ২০ দশমিক ৭২ টিসিএফ গ্যাস। উত্তোলনযোগ্য মজুতের পরিমাণ ৮ দশমিক ১৭ টিসিএফ যা ক্রমশ কমছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button