সহজে মিলছে না অর্থ, ভোগান্তি সরজমিন জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের গুলি-হামলায় হাজারো মানুষ শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২০ সহস্রাধিক মানুষ। জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শহীদ পরিবার ও আহতদের আর্থিক সহযোগিতার কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকার। ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম শুরুর পর নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সাহায্যের টাকা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে সেবাপ্রার্থীদের। পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি। ফাউন্ডেশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহু ধাপে যাচাই এবং দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে প্রয়োজনীয় সেবা দেয়া যাচ্ছে না। এজন্য সেবাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ধাপে ধাপে যাচাই প্রক্রিয়া থাকায় অনেকে দিনের পর দিন ঘুরছেন ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে। সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, শহীদ পরিবারের সদস্যরাও আসছেন সরকার ঘোষিত অনুদান গ্রহণ করতে। আহতদের কেউ কেউ আসছেন তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি করতে। আহত হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে তাদের বেশ কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হচ্ছে। দিতে হচ্ছে নানা তথ্য। এসব তথ্য দিতে গিয়ে অনেকে ভোগান্তিতে পড়ছেন।
গতকাল সকালে শাহবাগে ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শহীদ পরিবার ও আহতদের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত সময় পার করছেন ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। পাশেই দায়িত্ব পালন করছেন ভেরিফিকেশন অফিসার মো. প্রিন্স, মিডিয়া অ্যান্ড পিআরও কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন। খিলগাঁওয়ের ইনডোর গেমস ব্যবসায়ী মো. মাসুম এসেছিলেন আন্দোলনে আহত আলী নামের ১৩ বছরের এক পথশিশুর অর্থসহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে কি কি কাগজপত্র লাগবে তা জানতে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ১৭ই জুলাই আন্দোলনের সময় একটি দোকান থেকে পানি নিয়ে আন্দোলনকারীদের দিচ্ছিল আলী। একপর্যায়ে পুলিশের সামনে পড়ে যায়। তখন পুলিশ তার পা লক্ষ্য করে গুলি করে। আশপাশের লোকজন তাকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখন আলীর নামে বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে একটি স্বল্প পুঁজির ব্যবসার ব্যবস্থা করে দিতে চান মাসুম। এজন্য তিনি ফাউন্ডেশনের অফিসে এসেছেন আলীর নাম আহতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য।
গত ১৮ই জুলাই রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে গুলিবিদ্ধ হন সুমন হাওলাদার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ’ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’ এ প্রায় ২ মাস আগেই তার সকল তথ্য ভেরিফাইড হয়। কিন্তু এখনো টাকা না পাওয়ায় কয়েকদিন ধরে ফাউন্ডেশনের অফিসে ঘুরছেন। সুমনকে টাকা পাওয়ার আশ্বাস দিলেও কবে নাগাদ পাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলতে পারছে না ফাউন্ডেশন অফিস।
আন্দোলনে আহত মাঈদুলের মা সালমা আক্তার এসেছেন আহতদের তালিকায় তার ছেলের নাম অন্তর্ভুক্তি করতে। প্রায় দুই মাস আগে সকল তথ্য দেয়া হলেও এখন শুনেন ছেলের ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি অপেক্ষায় আছেন ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধর সঙ্গে দেখা করে তার অভিযোগ জানাতে।
গাইবান্ধা থেকে আসা আহত শাহাদুল হক জানেন না কীভাবে ভেরিফিকেশনের জন্য আবেদন করবেন। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে তার ফাইল ওপেন হলেও ভেরিফিকেশনের জন্য আজিমপুর কেন যেতে হবে সে প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছেন তিনি। আরেকজন সজীব ফারাজী ৪ঠা আগস্ট নারায়ণগঞ্জ বেকারীর মোড় এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ফাউন্ডেশনের অফিসে অনেক আগে সকল তথ্য দিয়ে গেলেও তার নামে কোনো ফাইল এখনো খোলা হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে অফিসে এসেছন তিনি।
মিরপুরের গাড়িচালক আপন এবং রুবেল। তারা এসেছেন এসএমএসে একবার তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তথ্য জানানোর পরেও পুনরায় তার ফাইল নাম্বার এবং ভোটার আইডি দিয়ে ভেরিফিকেশনের জন্য এসএমএস দেয়া হচ্ছে কেন তা জানতে। একবার তাদের নাম উঠছে, কিন্তু পুনরায় ভেরিফিকেশনের জন্য ভোটার আইডিসহ আপলোড দিতে তাতে কোনো সমস্যা হবে কিনা তা জানতে চাইছেন তারা। আন্দোলনে শহীদ সুমন শিকদারের বাবা বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে এসেছেন। নিহতের স্ত্রীর নামের গড়মিল থাকায় তিনি এসেছেন করণীয় সম্পর্কে জানতে। স্ত্রীর নামের প্রত্যায়নপত্র নিয়ে উপস্থিত কর্মকর্তা অনলাইনে পাঠানোর পরামর্শ দেন।
১৯শে জুলাই, যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে আহত হওয়া মুজাহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমি ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের’ প্রধান নির্বাহী সিগ্ধ ভাইয়ের সঙ্গে যাত্রাবাড়ীতে একটি প্রোগ্রামে দেখা করে আমার আহত হওয়ার সব তথ্য দেই। কিন্তু পরে গিয়ে দেখি তাদের ওয়েবসাইটে আহতদের তালিকায় আমার নাম নেই। তাই আমি কিছুদিন পূর্বে আবার ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের’ অফিসে গিয়ে সব তথ্য দিয়ে আসি। তখন কয়েকবার আমাকে ফোন দিয়ে ভেরিফিকেশনের জন্য বিভিন্ন তথ্য নেয় তারা। কিন্তু এখনো কোনো খবর নেই। চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন জুলাই ফাউন্ডেশনের ১৬০০০ নাম্বারে ফোন দিলে তারা ফোন-ই ধরে না। আমি অসুস্থ মানুষ। আমার পক্ষে প্রতিদিন জুলাই ফাউন্ডেশনে গিয়ে খোঁজখবর নেয়া সম্ভব নয়, তাই এখন আর ফাউন্ডেশনের অফিসে যাই না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পুলিশি নির্যাতনে আহত মো. মোর্শেদ আলম বলেন, আমি আন্দোলন করেছি মোহাম্মদপুর আল্লাহ করিম মসজিদের সামনে। ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালে ১৫ দিন ভর্তি থেকে দুটি অপারেশন করিয়েছি। আমার স্থায়ী ঠিকানা রংপুর হওয়ায় অসুস্থ শরীর নিয়ে সেখানে গিয়ে ভেরিফিকেশন করতে হয়েছে। এটি অনেক ভোগান্তির বিষয়। তিনি বলেন, আন্দোলনের সময়ে ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকরিরত থাকলেও আহত হওয়ার পর থেকে বেকার। ৪ মাস হলো বাড়িভাড়া দিতে পারছি না। দুইবেলা ডাল-ভাত জোটাও অনেক কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, গত ২২শে অক্টোবর জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে নিজে ফরম জমা দিয়েছি। এখনো কোনো সাহায্য পাইনি। এখন পর্যন্ত অনেকবার ১৬০০০ নম্বরে ফোন দিয়েছি তারাও কোনো আপডেট দিচ্ছে না। আমার শারীরিক কন্ডিশন এতটাই খারাপ যে আমার পক্ষে বার বার ফাউন্ডেশনে যাওয়া সম্ভব না। আমার এ মুহূর্তে উন্নতি চিকিৎসার প্রয়োজন।
মোহাম্মদপুরের আরেক বাসিন্দা জিহাদুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনে দুই হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাইনি। জিহাদুল মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্বজন এবং আহতদের নিয়ে একটি সংগঠন গঠনের কাজ করছেন। কিন্তু এসব সংগঠন যেন না করা হয় সেজন্য একটি গ্রুপ তার ওপর চাপ প্রয়োগ করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ছাত্র আন্দোলনে আহত নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করা সুমন বলেন, আন্দোলনে হাঁটুর গোড়ালিতে গুলি লাগে। প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাইনি। আহত হওয়ার পর চাকরিটা চলে যায়। ৩ মাসের বাসাভাড়া বাকি। দুই মাস আগে জুলাই ফাউন্ডেশনে প্রয়োজনীয় সব তথ্য দিয়ে আসলেও এখনো পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাননি বলে দাবি তার।
নুরেন্নাহার চিনু নামে মধ্যবয়সী এক নারী বলেন, আমার ছেলে আন্দোলনে যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। বার বার আশ্বাস পেলেও জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাইনি।
অভিযোগের বিষয়ে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের’ মিডিয়া অ্যান্ড পিআরও কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘এমআইএস’ ওয়েবসাটের মাধ্যমে আহতদের যে তালিকা করেছে সেটি ডিসি অফিস থেকে ভেরিফিকেশন করা হয়। কিন্তু ডিসি অফিসে ফ্যাসিস্টদের অনুসারী অনেক কর্মকর্তা সেটির মিসইউজ করছে। তাই আমরা এমআইএস ওয়েবসাইটকে প্রাইমারি সোর্স ধরে নিজেরা আবার ভেরিফিকেশন করে থাকি। মূলত ডাবল ভেরিফিকেশনের কারণে অনেকের ক্ষেত্রে সময় লাগছে। তিনি বলেন, শিগগিরই জুলাই ফাউন্ডেশনের সকল কার্যক্রম মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। আশা করছি তখন ভোগান্তি কমে আসবে।
অদক্ষ জনবলের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে লোকবল নিয়ে থাকি। বর্তমানে ৩০ জনের মতো লোক সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এত অল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা কঠিন। তবে জনবল বাড়ানো ও দক্ষতা বাড়ানো নিয়ে কাজ করছি।