Bangladesh

সাইবার নিরাপত্তা আইন দেশকে স্বর্গরাজ্য না বানাক, জেলখানা যাতে না বানায়

বিএফইউজে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিচ্ছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। জাতীয় প্রেসক্লাব, ৫ সেপ্টেম্বর

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সেগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। তাঁরা বলছেন, সংবাদকর্মীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনো কোনো ধারার খপ্পরে আগেও যেমন পড়েছেন, প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে এবারও রেহাই মিলবে না।

তাঁদের অভিমত হলো, সাইবার নিরাপত্তায় আইন সময়ের দাবি। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, সেই আইন দেশকে স্বর্গরাজ্য না বানাক, জেলখানা যাতে না বানায়। সেটিই সাংবাদিক সমাজের প্রত্যাশা।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিক নেতারা এসব কথা বলেন। বিএফইউজে—বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন বিষয়ে বিএফইউজের উপস্থাপনা’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সেখানে প্রস্তাবিত আইন নিয়ে বিএফইউজের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ আইনমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় আইনমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত আইনের বিলটি আজ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করা হবে। এরপর সেটি সংসদীয় কমিটিতে যাবে। সংসদীয় কমিটিতে এ নিয়ে সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিএফইউজের দেওয়া কিছু কিছু সুপারিশ বিবেচনার আশ্বাস দেন আইনমন্ত্রী।

গত ২৮ আগস্ট ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’–এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তাতে শাস্তি কমানো হয়েছে। জামিনযোগ্য ধারাও বাড়ানো হয়েছে। মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের অপরাধের (প্রমাণিত হলে) ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের পরিবর্তে শুধু জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তবে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তার প্রায় সবই প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে। আবার অপরাধের অনেক সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, আগের মতোই রয়ে গেছে। এ কারণে হয়রানির আশঙ্কা রয়েই গেছে। এ ছাড়া অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করেই আইনের খসড়াটি অনুমোদন করা নিয়েও আলোচনা চলছে।

এই আলোচনার মধ্যেই প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করল বিএফইউজে। সেখানে বিএফইউজের পক্ষ থেকে চার পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের হাতে তুলে দেন বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুক ও মহাসচিব দীপ আজাদসহ বর্তমান ও সাবেক নেতারা।

আলোচনা সভায় ওই সব পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলো উপস্থাপন করেন বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। শুরুতেই তিনি বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। ওই আইনটি নিয়ে ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে দেওয়া মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের একটি বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এসে প্রমাণিত হলো, পৃথিবীর কোনো দেশ এই আইন তো অনুসরণ করেনি বরং সভ্য সমাজ বলছে এই আইনের কারণে বাংলাদেশ স্বর্গরাজ্য হয়নি, জেলখানাই হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সাইবার অপরাধ দমনের জন্য আমরা সাইবার নিরাপত্তা আইন চাই। কিন্তু তা যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যে সাংবিধানিক সুরক্ষা তাকে বিপন্ন না করে।’

মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারায় জামিনের সুযোগ বাড়ল বটে; কিন্তু কিছু ধারায় অস্বাভাবিক জরিমানার বিধান যুক্ত করা হলো। সেই জরিমানা দিতে না পারলে জেলে যাওয়ার খড়্গ মাথার ওপর ঝুলেই থাকল।

যেসব সুপারিশ করল বিএফইউজে
বিএফইউজের লিখিত সুপারিশে বলা হয়, ফৌজদারি আইনে যেসব অপরাধ ও সাজা নির্ধারণ করা আছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনে তা সংযোজন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, এই আইনে ২০০ বছরের বেশি পুরোনো অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে নতুন করে জীবন দেওয়ার কোনো মানে হয় না। বিএফইউজে এর বিরোধিতা করে।

বিএফইউজে মনে করে, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪২ ধারায় অপরাধের সংজ্ঞা ও প্রয়োগ প্রক্রিয়া আরও সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। যেমন ৮ নম্বর ধারার উপধারা ২এ ‘যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট প্রতীয়মান হয়…।’ এখানে ‘প্রতীয়মান’ শব্দটিকে বিপজ্জনক উল্লেখ করে বিএফইউজে বলছে, আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো অভিযোগ প্রাপ্তি, তদন্ত বা প্রমাণের আগেই শুধু ‘প্রতীয়মান’ হওয়ার ভিত্তিতে অবারিত ক্ষমতার প্রয়োগ রাখার বিধান বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।

এ ছাড়া ২১ ধারায় জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ক্ষেত্রে ‘বিরুদ্ধে’–এর পরিবর্তে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা উচিত বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কু‍ৎসামূলক প্রচারণা চালানো হবে অপরাধ। এসব অভিযোগ ও এসবের প্রতি সমর্থনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকতে হবে। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি সংজ্ঞায় স্পষ্টীকরণ করা হয়েছে বলে মনে করে বিএফইউজে। এই প্রস্তাবটি বিবেচনায় নেওয়ার আশ্বাস দেন আইনমন্ত্রী।

২৫ ধারার কথা উল্লেখ করে বিএফইউজে বলছে, আক্রমণাত্মক, মিথ্যা ও ভীতি প্রদর্শক তথ্য–উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি আরও সুনির্দিষ্ট করা দরকার বা বাতিল করা দরকার। আর ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাতসংক্রান্ত ধারা আরও স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট করা দরকার।

এ ছাড়া মানহানিসংক্রান্ত ২৯ ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় আনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না বিএফইউজে। কারণ, এ বিষয়টি পেনাল কোডে (ধারা ৪৯৯) আছে। অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনসংক্রান্ত ৩২ ধারাটি পুরোপুরি বাতিল চায় বিএফইউজে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪২ ধারায় পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের বিষয় রয়েছে। এই ধারায় পুলিশের উপপরিদর্শকের নিচে নন এমন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তাকে পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই রাখা হয়েছে। বিএফইউজে মনে করে, এটিই হচ্ছে আইনের অব্যবহার ও অপপ্রয়োগের মূল শক্তি। এই ধারাটি অক্ষুণ্ণ রেখে আইনের অপব্যবহার হবে না, সেই বিষয়টি কোনোভাবেই নিশ্চিত করা যাবে না। সংবাদকর্মীরা এর খপ্পরে আগেও যেমন পড়েছিলেন, এবারও রেহাই মিলবে না। তাই বিএফইউজের প্রস্তাব হলো, সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এই ধারা রহিত করতে হবে। কোনোভাবেই এই ধারায় সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীকে পেশাগত কোনো কাজের জন্য গ্রেপ্তার করা যাবে না। কোনো সাংবাদিকের কোনো কাজের আপত্তি থাকলে সমন জারি করে আদালতে হাজির হতে বলা যাবে। আর সাংবাদিকের নামে কোনো মামলা করার প্রাথমিক গ্রহণযোগ্যতা (প্রাইমা ফেসি) যাচাইয়ের জন্য প্রেস কাউন্সিলের মতামত নিতে হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও এ ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য আনার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।

এ ছাড়া এই আইনে কেউ মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা করলে তার (বাদীর) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে বিএফইউজে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এই বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দেন এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।

একই সঙ্গে ‘জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সিতে’ একজন সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম বিশেষজ্ঞ রাখা এবং জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিলে বিএফইউজের সুপারিশ অনুযায়ী একজন সাংবাদিক বা গণমাধ্যমবিশেষজ্ঞ রাখার প্রস্তাব সুপারিশ করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, সাংবাদিকতায় ঝুঁকি থাকবে। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কোনো দিন সাহসী, সুষ্ঠু সাংবাদিকতা হতে পারে না। তাই অনুরোধ থাকবে, কোনো আইন যেন সাংবাদিকদের অধিকার, মর্যাদা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বাধাগ্রস্ত না করে।

বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুকের সভাপতিত্বে এবং মহাসচিব দীপ আজাদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, বর্তমান সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন প্রমুখ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor