Bangladesh

সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ

গত বছর জুনে পাঠানো কারিগরি নোটের অনেক বিষয় খসড়ায় স্থান পায়নি

বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) সংশোধন করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে ডিএসএর ‘গুরুতর ঘাটতি’র বেশ কিছু বিধান প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে থাকায় হতাশাও প্রকাশ করেছেন তিনি। র‌্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারকে এক চিঠিতে বিষয়টি জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারের চিঠি পাঠানোর দিন সকালেই বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এর আগে গত ৭ আগস্ট মন্ত্রিসভা সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন করেছিল। সাইবার নিরাপত্তা আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় চারটি ধারা অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে।

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনকে আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে গঠণমূলকভাবে সম্পৃক্ত থাকতে আইরিন খান চিঠিতে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার, ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউয়ের (ইউপিআর) বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের বিশেষ প্রক্রিয়া এবং স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার হিসেবে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক উদ্বেগ জানিয়েছিলেন।

গত বছর জুনে মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর বাংলাদেশ সরকারকে একটি কারিগরি নোট পাঠিয়েছিল। সেই নোটের অনেক বিষয়ই সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় স্থান পায়নি বলে তিনি জানান।

তিন মন্তব্য

জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে তিনটি মন্তব্য করেছেন। প্রথমত, খসড়া আইনে অস্পষ্ট ও অধিক বিস্তৃত বিধান থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এর মাধ্যমে বৈধভাবে মত প্রকাশকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায়।

এই বিধানগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নতুন রূপ হিসেবে এসেছে। এগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীদের ওপর এগুলো প্রয়োগ করা হয়েছে। এর ফলে তাঁদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আক্রান্ত হয়েছে।

দীর্ঘ মেয়াদে কারাবন্দিত্ব ও মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

দ্বিতীয় মন্তব্যে জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার বলেছেন, খসড়া আইনে শাস্তিগুলো অসামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে কঠোর করা হয়েছে। সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজার মাত্রা কমাতে বা বাদ দিতে চেয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে জামিনের সুযোগ বাড়িয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কারাদণ্ড বাদ দিয়ে বড় অঙ্কের অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো অর্থবহ হওয়ার মতো খুব তাৎপর্যপূর্ণ হবে না।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে তৃতীয় মন্তব্যে স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার বলেছেন, প্রস্তাবিত এই আইনে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনটি যাতে সত্যিকার অর্থেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়, সে জন্য একে আইনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার আহ্বান জানিয়েছেন স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান। তিনি আশা করেন, প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে উত্থাপনের আগে সরকার আরো সংশোধন করবে।

বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা

জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) ১৯ ধারা অনুযায়ী বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করতে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ওই চুক্তি করেছিল।

রাজনৈতিক মতামত

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা নিয়ে প্রপাগান্ডা চালানোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। জাতিসংঘ কমিটির মতে, রাষ্ট্রপ্রধানসহ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সমালোচনা এবং রাষ্ট্রের পতাকা, জাতীয় প্রতীক বা ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে মতামত আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত বৈধ অভিব্যক্তি।

জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারের আশঙ্কা, এই ধারার অপরাধের পরিধির বিস্তৃতি ও অস্পষ্টতা রাজনৈতিক মত প্রকাশের ওপর বেআইনি বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারে।

ধর্মীয় বিদ্বেষ

প্রস্তাবিত আইনের ২৮ ধারায় ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত এবং ৩১ ধারায় বিভিন্ন সম্প্রদায় বা শ্রেণির মধ্যে বিদ্বেষ, ঘৃণা বা বৈরিতা সৃষ্টিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার বলেছেন, ২৮ ধারা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ওই ধারা বাদ দেওয়া উচিত। আর ৩১ ধারাকে আইসিসিপিআরের ২০(২) ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা উচিত।

অপরাধমূলক মানহানি ও মিথ্যা তথ্য

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা (আপত্তিকর, মিথ্যা ও হুমকি সৃষ্টিকারী ডাটা তথ্যবিষয়ক) এবং ফৌজদারি মানহানিবিষয়ক ২৯ ধারা বাংলাদেশ সরকারের সমালোচকদের আটক করতে ব্যবহার করা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সাইবার সিকিউরিটি আইনেও এগুলো থাকাকে বিরক্তিকর বলে উল্লেখ করেছেন স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার।

সাইবার সন্ত্রাস

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাস খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনেও স্থান পেয়েছে। স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার বলেছেন, সাইবার সন্ত্রাসের সংজ্ঞা অনেক বিশদ ও অস্পষ্ট। সন্ত্রাসের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞার কোনো উপাদান সেখানে উল্লেখ করা হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের সুপারিশ অনুযায়ী সন্ত্রাসের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুমোদন করতে চিঠিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

অসামাঞ্জস্যপূর্ণ শাস্তি

জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারের মতে, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে কেবল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থাকা অপরাধের দীর্ঘ তালিকাই সংযোজন করা হয়নি, শাস্তির বিধানও যোগ করা হয়েছে। অপরাধের সংখ্যা ও শাস্তির মাত্রা কমাতে স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন।

নিয়ন্ত্রক ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা

খসড়া আইনের ৮ ধারায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে (বিটিআরসি) ডিজিটাল নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলা ওয়েবসাইটগুলোতে প্রবেশাধিকার সীমিত করার বা তথ্য-উপাত্ত মুছে ফেলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়া উচিত বলে চিঠিতে মন্তব্য করা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অভিজ্ঞতার আলোকে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলোর বিষয়ে স্বাধীন বিচারিক নজরদারি রাখতে সুপারিশ করেছেন স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার। প্রস্তাবিত আইন নিয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসারও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button