Trending

সাগরতলে আবিষ্কারের অপেক্ষায় ৩০ লাখ জাহাজের ধ্বংসাবশেষ!

এলিয়াস স্টাডিয়াটিস যখন সাগরের বেগুনি-নীল পানির নিচে ডুব দিলেন, তখন ভাবছিলেন ডুবুরি হিসেবে হয়ত তাকে আরেকটি গড়পড়তা দিনের মতোই নানা কিছু খুঁজে ফিরতে হবে। তার পরনে ভারী ডাইভিং স্যুট, নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য মুখে লাগানো রাবারের নল।

সাগরের তলায় এসে পৌঁছানোর পর চোখ মিট মিট করে তিনি যা দেখলেন, তাতে ভয়ে আঁতকে উঠলেন। তার চারপাশে মনে হচ্ছে ছড়িয়ে আছে বহু খণ্ড-বিখণ্ড মানবদেহ, পানির নিচে সেসবের ঝাপসা আকার বেশ বোঝা যাচ্ছে। এলিয়াস যখন বুদবুদ ছড়িয়ে পানির উপরে ভেসে উঠলেন। হন্তদন্ত হয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জানালেন, সাগরের নিচে তিনি লাশের স্তূপ খুঁজে পেয়েছেন।

এটা ১৯০০ সালের বসন্তকালের ঘটনা। এলিয়াস আসলে সেদিন ঘটনাচক্রে আনটিকিথেরা জাহাজডুবির সন্ধান পেয়েছিলেন। এই মালবাহী রোমান জাহাজটি সাগরে ডুবে গিয়েছিল দুই হাজার বছরেরও বেশি আগে। তবে শিগগিরই বোঝা গেল, এ জাহাজটির ধ্বংসাবশেষে এলিয়াস লাশের স্তূপ বলে ভেবেছিলেন যেগুলোকে, সেগুলো আসলে শিল্পকর্ম। মার্বেল পাথর এবং ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। কিন্তু হাজার বছর ধরে সাগর তলে শ্যাওলা আর নানা সামুদ্রিক প্রাণীর মাঝখানে সেগুলোর ওপর এক অদ্ভুত প্রলেপ পড়েছে।

এজিয়ান সাগরে গ্রিসের একটি দ্বীপের উপকূলে আনিটিকিথেরা থেকে উদ্ধার করা সেসব ভাস্কর্য এক শ’ বছরেরও বেশি সময় পরে এখনো মানুষকে মুগ্ধ করে চলেছে। কিন্তু সাগরতলে এরকম বহু জাহাজে আরো অনেক বিস্ময়কর নিদর্শন এখনো আবিষ্কারের অপেক্ষায় পড়ে আছে।

ইউনেস্কোর একটি সাম্প্রতিক অভিযানের কথা ধরা যাক। এটি চালানো হয় স্কার্কি ব্যাংক বলে একটি জায়গায়। পূর্ব এবং পশ্চিম ভূমধ্যসাগরকে যুক্ত করেছে সাগরের এ অগভীর অংশটি, যেটি জাহাজ চলাচলের জন্য খুবই বিপদজনক। কারণ সেখানে পানির নিচে অনেক প্রবাল পাথর। হাজার হাজার বছর ধরে এই পথে বহু জাহাজ ডুবি হয়েছে।

শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে এবং পানির নিচে রোবট পাঠিয়ে এই এলাকার সাগরতলের একটি মানচিত্র তৈরির কাজ করেছিলেন আটটি দেশের একদল বিজ্ঞানী। এ সপ্তাহে তারা ঘোষণা করলেন, সেখানে তিনটি ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ইউনেস্কোর ধারণা, বিশ্বের সাগরগুলোর ঢেউয়ের নিচে হয়ত আর বহু ডুবে যাওয়া জাহাজ আবিষ্কার হওয়া বাকি।

চাপা পড়া ইতিহাস

বিশ্বে এযাবতকালের সবচেয়ে পুরনো নৌকাটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল নেদারল্যান্ডসে একটি মহাসড়ক তৈরির সময় ঘটনাচক্রে। কাঠের নৌকাটি দশ হাজার বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হয়। তবে এরকম অনেক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে মানুষ হয়ত তারও বহু আগে সাগর পাড়ি দিতে শিখেছিল। হঠাৎ করেই মানুষের দেখা পাওয়া যেতে শুরু করেছিল বিশাল সাগরের অপর তীরে।

প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একদল শিকারি মানব একের পর এক দ্বীপ ডিঙ্গিয়ে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কারণ এরপরই অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের দেখা মিলেছিল নিউ সাউথ ওয়েলসের লেক মাঙ্গুতে।

আর যেখানেই এরকম সাগর পাড়ি দেয়ার ব্যাপার থাকবে, সেখানেই জাহাজডুবিও ঘটবে। বিশ্বে হাজার হাজার বছর ধরে যে বাণিজ্য হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, নানা অভিযান চলেছে- বিশ্বের সাগরতলে আসলে সেসবের ধ্বংসাবশেষ লুকিয়ে আছে। সেখানে হয়ত আছে রূপা বোঝাই দস্যু জাহাজ, মালামাল বোঝাই নৌকা, বিলাসবহুল রাজকীয় তরী, যা হয়ত অদৃশ্য হয়ে গেছে কোনো ভবিষ্যতের রাজাকে নিয়ে। প্রাচীন মাছধরা নৌকা, আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, অথবা টাইটানিকের মতো বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজ- কী নেই সাগরতলে।

এই ডুবে যাওয়া জাহাজগুলো যেন একেকটা টাইম-ক্যাপসুল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এগুলো খুঁজে পাওয়ার জন্য পাগল। এগুলোতে পাওয়া গেছে প্রাচীনকালের বিস্ময়কর যেসব নিদর্শন, সেগুলোতে ভর্তি বিশ্বের নামকরা মিউজিয়ামগুলো। যেমন আনটিকিথেরা থেকে পাওয়া গিয়েছিল এক রহস্যময় মহাজাগতিক ঘড়ি, যেটি কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে আসলে বিশ্বের প্রাচীনতম কম্পিউটার।

তাহলে এরকম কত জাহাজ পড়ে আছে সাগরের তলে- পানির গভীরে কত জাহাজ এখনো আবিষ্কারের অপেক্ষায়?

বিশ্বের জাহাজডুবির ঘটনাগুলোর বেশ কয়েকটি তথ্যপঞ্জি আছে। এ পর্যন্ত কত ডুবে যাওয়া জাহাজ খুঁজে পাওয়া গেছে, সেটির আনুমানিক হিসেব একেকটি তথ্যপঞ্জিতে একেক রকম।

একটি অনলাইন সাইট, রেক-সাইটে দুই লাখ নয় হাজার ৬৪০টি জাহাজডুবির তালিকা আছে। এর মধ্যে এক লাখ ৭৯ হাজার ১১০ টি জাহাজ কোথায় ডুবেছে, সেই স্থানের কথাও উল্লেখ আছে। অন্যদিকে গ্লোবাল মেরিটাইম রিক ডেটাবেজে (জিএমডাব্লিউডি) আছে আড়াই লাখের বেশি ডুবে যাওয়া জাহাজের তালিকা, যদিও এর মধ্যে অনেকগুলো এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।

একটি আনুমানিক হিসেবে বলা হচ্ছে, কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই ১৫ হাজার জাহাজ ডুবেছে- আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরের নানা জায়গায় অনেক যুদ্ধজাহাজ আর ট্যাংকার ডুবে আছে।

আসলে যত জাহাজডুবির ঘটনা এ পর্যন্ত জানা গেছে এবং তালিকাভুক্ত হয়েছে, তা বাস্তবে ঘটা জাহাজডুবির একেবারেই একটা ক্ষুদ্র অংশ বলে মনে করা হয়। ইউনেস্কোর একটি বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিশ্বের সাগরতলে হয়ত ৩০ লাখের বেশি জাহাজডুবির ঘটনা আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে।

তবে এসবের ধ্বংসাবশেষ যে সাগরের সব জায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে আছে, ব্যাপারটা তা নয়। সাগরে এমন কিছু অঞ্চল আছে, সেখানে ঘন ঘন জাহাজডুবি হয়। বিশেষ করে সাগরের যেসব পথ দিয়ে বেশি জাহাজ চলাচল করে, বা যেই পথ বেশি বিপদসঙ্কুল। এরকম এলাকাগুলো অতীতে ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধানের জন্য ভালো জায়গা বলে প্রমাণিত হয়েছে।

স্কার্কি ব্যাংক এরকম একটি জায়গা। কিংবা ভূমধ্যসাগরের ফোর্নি আর্কিপেলাগোর কথাও বলা যেতে পারে। এসব জায়গায় এ পর্যন্ত ৫৮টি ডুবে যাওয়া জাহাজ খুঁজে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কেবল ২০১৫ সালে মাত্র ২২ দিনেই খুঁজে পাওয়া যায় ২৩টি জাহাজ।

ফোর্নি আর্কিপেলাগো যদিও সেরকম বিপদজনক এলাকা নয়, সেখানে বহু জাহাজ আসতো নোঙর করতে। সেখানে যেহেতু অনেক বেশি জাহাজ আসা-যাওয়া করতো, সেকারণেই সেখানকার সাগরতলে এত বেশি জাহাজডুবির নিদর্শন পাওয়া গেছে বলে মনে করা হয়।

মূল্যবান নিদর্শন

আগের যুগে মানুষ কিভাবে জীবন-যাপন করতো, তার নানা চিত্তাকর্ষক নিদর্শন আছে সাগরের তলায় লুকিয়ে থাকা এই অনাবিস্কৃত ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোতে। তবে এগুলোতে হয়ত মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো বিপুল মূল্যবান সম্পদও আছে। এটা আবার একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এটি ছিল একটি স্প্যানিশ নৌবহরের অংশ। এই বহরে ছিল আরো অনেক জাহাজ এবং নৌকা। সেগুলোতে বোঝাই ছিল চিনি, মশলা, মূল্যবান ধাতু এবং অন্যান্য পণ্য। স্পেন এবং তার আমেরিকান উপনিবেশগুলোর মধ্যে এগুলোতে করে পণ্য পরিবহন করা হত।

এই নৌবহরের প্রধান জাহাজ ছিল স্যান হোসে। সেটিতে বোঝাই ছিল রূপা, পান্না, সোনা- এরকম সব মূল্যবান ধাতু। কিন্তু একটি ব্রিটিশ জাহাজের সঙ্গে সহিংস সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল এটি। কয়েক ঘণ্টা ধরে লড়াইয়ের পর স্যান হোসে জাহাজের গান পাউডারের গুদাম বিস্ফোরিত হয় এবং সাথে সাথে জাহাজটি ডুবে যায়। ছয় শ’ নাবিক সহ জাহাজটি সাগরের পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়।

এর প্রায় তিন শ’ বছর পর ২০১৫ সালে কলম্বিয়ান নৌবাহিনী শেষ পর্যন্ত এই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়। জাহাজের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে কামান, সিরামিক, মূদ্রা এরকম অনেক কিছু পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, এই জাহাজে ছিল প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের মালামাল। কিন্তু জাহাজটি আবিস্কৃত হওয়ার পরপরই এর মালিক কে তা নিয়ে তিক্ত বিবাদ শুরু হয়। এই প্রত্মতাত্ত্বিক স্থানটি থেকে এখন সম্পদ লুন্ঠন করা হবে বলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

স্যান হোসে আবিস্কৃত হওয়ার পর গবেষকরা আরো দু’টি শতাব্দী প্রাচীন ডুবে যাওয়া জাহাজ খুঁজে পেয়েছেন কলম্বিয়ার উপকূলে।

এক সোনালী যুগ 

এ ধরণের বিতর্ক সামনের দিনগুলিতে বারে বারে সামনে আসবে।

অতীতে অনেক ডুবে যাওয়া জাহাজ খুঁজে পাওয়া যেত তুলনামূলকভাবে অগভীর পানিতে। জেলেরা, বিজ্ঞানীরা কিংবা যারা লুকায়িত সম্পদের খোঁজে থাকে- তারা হয়ত ঘটনাচক্রে সাগর উপকূলে এরকম জাহাজ খুঁজে পেত। কিন্তু এখন অত্যাধুনিক সাবমরিন, ক্যামেরা এবং শব্দতরঙ্গ প্রযুক্তির কল্যাণে গভীর সাগরের তলদেশেও ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধান করা অনেক সহজ হয়ে গেছে।

সাগরের সবচেয়ে গভীর অংশের মানচিত্র তৈরি করাও এখন সম্ভব। ২০১৯ সালে গবেষকরা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস জনস্টোন খুঁজে পান ফিলিপাইনের কাছে সাগরের ছয় কিলোমিটার গভীরে।

আর এবছরের শুরুতে বিজ্ঞানীরা টাইটানিক জাহাজের এক অবিকল ত্রিমাত্রিক ডিজিটাল প্রতিকৃতি তৈরি করেন আটলান্টিকের নিচে ডুবে থাকা জাহাজটি জরিপ করে।

প্রযুক্তির এই উন্নতির ফলে সাগরের নিচে লুকিয়ে থাকা অনেক কিছু এখন অভূতপূর্ব হারে প্রকাশ পাচ্ছে। যেভাবে শব্দতরঙ্গে এবং জিপিএস প্রযুক্তি মাছ ধরার ব্যাপারটি পুরো বদলে দিয়েছে। টিউনা মাছের ঝাঁককে এখন গভীর সমুদ্রে পর্যন্ত খুঁজে বের করা যাচ্ছে। সেই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন যে কেউ অনেক ডুবে যাওয়া জাহাজ খুঁজে বের করতে পারবে, যেটা আগে সম্ভব ছিল না।

তবে এখনো অনেক ডুবে যাওয়া জাহাজ খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষায়। এর মধ্যে অনেক বিখ্যাত জাহাজডুবির ঘটনা আছে। যেমন- ধরা যাক ওয়ারাটাহর কথা। এই বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজটিকে টাইটানিকের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এটি ১৯০৯ সালের ২৬ জুলাই ডারবান থেকে কেপটাউনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। জাহাজটিতে ছিল ২১১ জন যাত্রী। কিন্তু তারপর এটি অদৃশ্য হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত কেউ জানে না কী ঘটেছিল, কোথায় জাহাজটি ডুবে গিয়েছিল। এটি খুঁজে বের করার জন্য এ পর্যন্ত নয়টি অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি।

কে জানে, এরপর আবার কী খুঁজে পাওয়া যাবে। একটা বিষয়েই কেবল সুনিশ্চিত, খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদের খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button