সাড়ে ৩ কোটির জমিতে হাজার কোটি ঋণ
আটা, ময়দা ও সুজির একটি কারখানায় এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। সৌভাগ্যবান এই কারখানার নাম সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, যার অবস্থান চট্টগ্রাম নগরীর সাগরিকা বিসিক শিল্প এলাকায়। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব জমি বন্ধক নিয়ে এই ঋণ ছাড় করা হয়েছে, সেগুলোর মৌজামূল্য মাত্র সাড়ে তিন কোটি টাকা। এমনকি ওই জমির দলিলও ভুয়া বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। নামস্বর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে কার্যত ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র।
এক হাজার কোটি টাকা ঋণ পাওয়া কারখানাটি দেখতে কেমন, কেমনই বা এখানকার কর্মযজ্ঞ, তা দেখতে গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে যায় কালের কণ্ঠ। চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর সংযোগ সড়ক থেকে সাগরিকা রোডে ঢুকলে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের আগে হাতের ডানে বিসিক শিল্প এলাকা। এ ব্লকে দুটি প্লট (এ-৫ ও এ-৬) নিয়ে ১৯৮০ সালে কারখানাটি স্থাপন করা হয়।
তবে কারখানার পরিধি এবং উৎপদন সক্ষমতা দেখে কারো বিশ্বাস হচ্ছে না যে রুগ্ণ এই কারখানা এক কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারে। বরং হাজার কোটি টাকার ঋণের তথ্য শুনে বিস্ময়ের অন্ত নেই স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও।
ঋণ প্রদান সংক্রান্ত নথিপত্রে দেখা গেছে, গত বছরের ৬ এপ্রিল থেকে ১৫ মে দেড় মাসের মধ্যে ‘বাই মুরাবাহা (ব্যাংকের জিম্মায় পণ্য সংরক্ষণ করে ব্যবসা পরিচালনা)’ ক্যাটাগরিতে ৮৫০ কোটি টাকা সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ঋণ ছাড় দেয় ইসলামী ব্যাংক। বাকি ১৫০ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড বিনিয়োগ সীমা। বিনিয়োগকৃত ৮৫০ কোটি টাকা বর্তমানে মুনাফা-আসলে ৯২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলভার ফুডের ওই ব্যাংকে কোনো পণ্য আমদানির রেকর্ড নেই। ঋণের বিপরীতে কারখানার ভবন কাম গোডাউনসহ ২২ হাজার ২৯০ বর্গফুটের দুটি প্লট, ঢাকার নারায়ণগঞ্জে ৪৭২ শতক জমি ও প্রজেক্ট মেশিনারিজ কোলাটারেল বা জামানত হিসেবে দেখানো হয়েছে, যার ভ্যালু বা মূল্য দেখানো হয়েছে ১০৯ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঋণের বিপরীতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের বরুনা ও কায়েমশার মৌজার ৪.৭২ একর বা ৪৭২ শতাংশ জমি মর্টগেজ বা বন্ধক রাখে সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বন্ধকি জমির পুরোটাই নাল শ্রেণির।
এই দুই মৌজার ক্ষেত্রে নাল শ্রেণির জমির সর্বোচ্চ মূল্য প্রতি শতক ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা। সে হিসাবে বন্ধকি জমির মৌজামূল্য দাঁড়ায় তিন কোটি ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। অবশ্য ব্যাংকে ওই জমির দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।
ঋণ মঞ্জুরিপত্রে কম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. মামুনুর রশিদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহেদি হাসানের নাম উল্লেখ রয়েছে। বিস্ময়কর তথ্য হলো, ঋণ অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্ণধার মামুনুর ও মেহেদির টিআইএন নিবন্ধন হয়েছে ২০২৩ সালের ৩ এপ্রিল। কিন্তু এর পাঁচ মাস আগেই ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর তাঁদের নামে হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয় ইসলামী ব্যাংক।
জানা গেছে, মামুনুর রশিদের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভার সৈয়দ মাস্টার বাড়ি এবং মেহেদির স্থায়ী ঠিকানা ঢাকার সবুজবাগ। স্বাভাবিকভাবেই কারখানায় পটিয়ার কর্মীদের একচ্ছত্র দাপটের চিত্র দেখা গেছে সরেজমিন অনুসন্ধানে। অন্য কর্মীরা একপ্রকার কোণঠাসা বলে দাবি করেন।
নথিতে সিলভার ফুডের ঠিকানা হিসেবে লেখা রয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর খাতুনগঞ্জের ৩৪৭ জিলানী টাওয়ার। তবে গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে এ ঠিকানায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি কালের কণ্ঠ। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম কখনো শোনেননি বলে দাবি করেন। হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা পাওয়া এই মামুনুর রশিদ এবং সিলভার ফুড নামের প্রতিষ্ঠানটিকে চেনেন না খাতুনগঞ্জের কোনো ব্যবসায়ী।
পরে হামিদুল্লাহ মিয়া মসজিদ সংলগ্ন একটি ভবনে সিলভার ফুডের একটি সাইনবোর্ড নজরে আসে। ধুলার আড়ালে প্রতিষ্ঠানের নাম দেখে ভবনের ভেতরে গেলে দেখা যায়, চতুর্থ তলায় কাচে ঘেরা আঁটসাঁট একটি কার্যালয়। গ্লাস দিয়ে ভেতরে মাকড়সার জাল দেখা যাচ্ছে। অন্য প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারী জানান, চারতলার এই কার্যালয় বেশির ভাগ সময় খোলাই হয় না।
সিলভার ফুডের ‘ব্যবসার প্রকৃতি’ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘আটা, ময়দা ও সুজি ম্যানুফ্যাকচারিং ও ট্রেডিং’। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে আগের মালিক ফরিদ আহমেদের কাছ থেকে ১৮ কোটি টাকায় কারখানাটি কিনে নেন মামুনুর রশিদ। কারখানার কয়েকজন দায়িত্বরত কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, মালিকানা হাতবদলের আগে, অর্থাৎ ২০২২ সালের আগে প্রতিদিন গড়ে ১৬০ টন আটা, ময়দা ও সুজি উৎপদন হতো। এখন তার অর্ধেকও হয় না।
এদিকে আটা-ময়দার কারখানার সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা জানান, যদি প্রতিদিন দেড় শ টনও উৎপদন হয়, তা-ও এই উৎপদন সক্ষমতার একটি কারখানায় স্থানীয় বাজার থেকে গম কিনে আটা-ময়দা উৎপদন করতে সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন।
ইসলামী ব্যাংকের আন্দরকিল্লা শাখার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করলে তাঁদের ভাষ্য, প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের ঋণছাড়ের কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাই ভালো বলতে পারবেন।
তবে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা ফোন রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় এস আলম গ্রুপ যুক্ত হওয়ার পর থেকেই ব্যাংকটিতে দুরবস্থা দেখা দিয়েছে। নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়নি। এসব ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে আরো বেশি সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।
তিনি আরো বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক কমিশন গঠন করছে। তাদের নেতৃত্বে জালিয়াতির মাধ্যমে দেওয়া ভুয়া ঋণ এবং অর্থপাচারের প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে বলে আশা করছি। কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসবে।’
চেয়ারম্যান এমডির তথ্য অনুসন্ধানে যা জানা গেল
পটিয়ায় সরেজমিনে গেলে মামুনুর রশিদের এলাকার বাসিন্দারা জানায়, মামুনুর দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন। তবে প্রায় এক যুগ আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন। একসময় পটিয়া স্টেশনে ফিশ ফিড ও বাইপাস সড়কে চায়ের দোকান করলেও দু-তিন বছর ধরে এসব বন্ধ রয়েছে। নিকট অতীতে তাঁকে এলাকায় কয়েকটি ব্যাটারিচালিত রিকশা, টমটম, মাহিন্দ্রা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতে দেখা যেত। তবে সম্প্রতি স্থানীয় একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়েছেন বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে।
বন্ধকি জমির মূল মালিক পুলিশের সংগঠন
প্রতারণার জাল এতটাই বিস্তৃত যে বন্ধক রাখা জমিটিও ছিল ভুয়া। একে তো নামমাত্র মূল্যের জমি রেখে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি, তার ওপর ওই জমির মালিকানাই অন্য কারো। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছে জমিটি বিক্রি করেছিলেন মেহেদী হাসান দীপু ও কাওসার আহমেদ অপু নামের স্থানীয় দুই ব্যক্তি। এই তথ্য গোপন রেখে পরবর্তী সময়ে একই জমি বিক্রি করা হয় সিলভার ফুডের কাছে। যদিও দ্বিতীয় দফায় জমি কেনাবেচার বিষয়ে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ঋণ পেতে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের যোগসাজশে ভুয়া দলিল সাজানো হয়েছিল। আর এতে পুলিশের সংগঠনটির কাছে জমি বিক্রয়কারী দুই ব্যক্তিরও হাত ছিল।
সাগরিকা বিসিক শিল্প এলাকার সরেজমিন চিত্র
গতকাল দুপুরে চট্টগ্রামের সাগরিকা শিল্প এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানার ভেতর থেকে পণ্যবাহী ট্রাক বের হচ্ছে। এ ছাড়া কারখানাটির আশপাশে আরো অনেক ট্রাক অপেক্ষমাণ ছিল। কারখানার ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদককে বাধা দেন দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মী। ফলে কারখানার ভেতরে উৎপদন, শ্রমিক ও যন্ত্রপাতির অবস্থান জানা সম্ভব হয়নি।
কারখানায় কাজ করা কবির হোসেন নামের এক শ্রমিক কালের কণ্ঠকে জানান, এ কারখানায় আটা, ময়দা ও সুজি উৎপদন করে প্যাকেটজাত করা হয়। কয়েক বছর আগেও এই কারখানায় গড়ে উৎপদন হতো দেড় শ টনের বেশি। কিন্তু এখন এত উৎপদন হয় না। উৎপদন কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে কাজ হারিয়েছেন অনেক শ্রমিক। অনেক শ্রমিকের বকেয়াও আছে। তিনি বলেন, ২০২২ সালের পর কারখানাটির মালিকানা নিয়ে সমস্যা চলছে। এর পর থেকে উৎপদন কমতে শুরু করে।
আরেক শ্রমিক সানা উল্লাহ বলেন, ‘আগের মালিক ছিলেন ফরিদ আহমেদ নামের এক ব্যক্তি। এখন মালিক পটিয়ার মামুনুর রশিদ। তাঁকে আমরা কোনো দিন কারখানায় আসতে দেখিনি। চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকার লোকজন যাঁরা এখানে কাজ করেন, তাঁদের অনেক দাপট। তাঁরাই মূলত কারখানাটির দেখভাল করেন।’
কারখানার এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিলভার ফুড বাইরে থেকে কোনো কাঁচামাল আমদানি করে না। তারা লোকাল মার্কেট থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে পণ্য উৎপদন করে প্যাকেটজাত করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে বলে প্রচার করে। এমনকি ভুয়া বিল দেখিয়েও বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে। এ ছাড়া অনেকের বকেয়া এখনো পরিশোধ করেনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও মামুনুর রশিদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।