Bangladesh

সাড়ে ৩ হাজার সাইট বন্ধ তবু চলছে অনলাইন জুয়া, নিঃস্ব হচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকলেই দেখা যাবে দেশের কোনো তারকা বলছেন, ‘ঘরে বসে পুঁজি ছাড়াই আয় করতে চান? তাহলে এই অ্যাপে গেম খেলুন আর জিতে নেন লাখ লাখ টাকা।’ এমনই একটি অ্যাপ সিকে৪৪৪। এই অ্যাপের ব্যাপকভাবে প্রচারণা করছেন তরুণেরা। যেখানে লোভনীয় অফার ও অ্যাপে খেলার নিয়ম প্রচার করছে। আদতে এটি জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এর প্রচারণা চলছে এবং অনলাইনে জুয়া খেলতে আগ্রহ বাড়াচ্ছে। এই অ্যাপে এন্ট্রি নেওয়া এক জন জানালেন, অনলাইন জুয়া খেলে তিন দিনে আয় করেছেন ২৯ হাজার টাকা। তবে ছয় মাসে হারিয়েছেন ২ লাখ টাকা। এরকমভাবে অর্থ হারানোর প্রবণতাই বেশি। অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনলাইন জুয়ার আসরে।

বিজ্ঞাপন প্রচারসহ অনলাইনে জুয়া/বেটিংয়ের ওয়েবসাইট ও অ্যাপ্লিকেশন চিহ্নিত করা, এগুলোর কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হয়, তা নির্ণয় এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। তদন্ত করে ৯০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রবিবার রুলসহ এ আদেশ দেয়। তানজিম রাফিদ নামে রাজধানীর এক বাসিন্দা ১৬ এপ্রিল রিটটি করেন।         

আদালতের এই নির্দেশের পর গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন সাইবার সুরক্ষা আইনটি পাশ হবে বলে আশা করি। এই আইনে সাইবার স্পেসে জুয়া কিংবা অনলাইন জুয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন পাশ হওয়ার পর আমরা জুয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত কোম্পানিকে শাস্তি দেওয়া এবং বেটিং সাইটগুলো নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেব ইনশা আল্লাহ।’

তিনি লেখেন, ‘আমরা মোবাইল ব্যাংকিংসহ ফাইন্যান্সিয়াল অর্গানাইজেশনগুলোকে আগাম সতর্কতা জানিয়ে রাখি। কেননা সাইবার জুয়া কোম্পানিগুলো মোবাইল ব্যাংকিংসহ ব্যাংক, ফাইন্যান্সিয়াল হাউজ কিংবা পেমেন্ট গেটওয়ে, এমএফএস/পিএসও/পিএসপি ইত্যাদির সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড। মাসের পর মাস নির্দিষ্ট কিছু পুলের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ইরেগুলার, একমুখী এবং অস্বাভাবিক ট্রাঞ্জেকশন হচ্ছে। একটা পুল অফ নম্বরে টাকা যাচ্ছে, সেটা নির্দিষ্ট নম্বরে গিয়ে ক্যাশ আউট হয়ে বাইরে পাচার হচ্ছে, আপনি দেখেও না দেখার ভান করে বলবেন, আমি জড়িত নই! এটা হবে না। সুতরাং অবৈধ জুয়ায় জড়িত সবাই সাবধান।’

দিন দিন অনলাইনে জুয়াড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সারা দেশের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা অনলাইনে বাজিতে বুঁদ হয়ে থাকে। ফুটপাতের চা দোকানি থেকে শুরু করে সেলুন দোকানদার, হকার, বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী, বিক্রয়কর্মী থেকে শুরু করে ভবঘুরে, বাস-ট্রাকের চালক-হেলপার, সিএনজি চালক, নির্মাণশ্রমিক, গৃহপরিচারিকা, রিকশাচালক ও দিনমজুর শ্রেণির মতো একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন দিনের একটা সময় অনলাইনে বাজি ধরতেই ব্যস্ত থাকে। ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত এই শ্রেণির মানুষরা বাজি ধরে। এভাবেই নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার গত কয়েক বছরে ৩ হাজার ৫০০টিরও বেশি জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে। সিআইডি, ডিবি ও র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছে জুয়ার সাইট পরিচালনাকারী শতাধিক ব্যক্তি। তবে প্রতিটি সাইট বন্ধ করার পরপর এই চক্র ভিপিএন (ভয়েস ওভার প্রটোকল নেটওয়ার্ক) দিয়ে সাইটগুলো আবার সচল করে। 

বাংলাদেশে ক্যাসিনো সংস্কৃতি ২০১৯ সালে আলোচনায় আসে, যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজধানীর বেশ কয়েকটি অবৈধ ক্যাসিনোয় অভিযান চালায়। এরপর থেকেই নিষিদ্ধ অনলাইন ক্যাসিনোর দিকে ঝুঁকেছেন অনেকে। গত কয়েক বছরে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমে ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপন বেড়ে যাওয়ায় তরুণদের মধ্যে এটি আরও জনপ্রিয় হয়েছে।

অনলাইন সার্চের বিভিন্ন ধারার বিশ্লেষণকারী সফটওয়্যার এএইচআরইএফএসের তথ্য অনুসারে শুধু বাংলাদেশ থেকেই গত মার্চ মাসে সিকে৪৪৪ শব্দটি দিয়ে সার্চ করা হয়েছে ৯৫ হাজার বার। গুগল ট্রেন্ডসের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের রংপুর, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগে পর্যায়ক্রমে বেশি ব্যবহার এবং সার্চ করা হচ্ছে। এই কিওয়ার্ড দিয়ে একটি ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত মার্চে মোট ব্যবহারকারী বেড়েছে ৬ লাখ ১৬ হাজার। ওয়েবসাইটটি যাত্রা শুরু করেছে ১৪ মার্চ আর এক দিনেই ভিজিটর গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৯৭ জনে।

বাগেরহাটের এক তরুণ বলেন, ‘এই অনলাইন জুয়া একধরনের নেশা। যেখান থেকে বের হওয়া খুব কঠিন। আমি আসক্ত, চাইলেও ছাড়তে পারছি না। জিতি, হারি আবার খেলি। তবে আমার বেলায় জেতার পরিমাণ একটু বেশি, অনেকেই হেরে অনেক কিছু হারিয়েছেন। আমার নেশাটা আসলে ক্রিকেট ডটটিভি এই সাইটের ওপর।’ আরেক তরুণ বলেন, প্রতিটি উপজেলার ঘরে ঘরে দুয়েক জন অনলাইন জুয়ায় মোটামুটি আসক্ত। এখানে ঝুঁকে পড়েছেন ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও বেকার যুবকেরা। জুয়ার টাকা জোগাতে কেউ কেউ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব জুয়ার টাকা বেশির ভাগ লেনদেন হয়ে থাকে বিকাশ ও নগদে।

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বাজার কত টাকার, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে দেশের কত মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত, তার একটি আনুমানিক হিসাব গত সরকারের সময় পাওয়া গিয়েছিল। সেই হিসাবে দেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে গত বছরের ২০ জুন ভারতের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে অবৈধ অনলাইন বাজির বাজার বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ সংগ্রহ করে।

দেশে অনলাইন জুয়ার বিস্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত বছর একটি বিবৃতি দিয়েছিল। তরুণসমাজকে এর কবল থেকে রক্ষা করতে অবিলম্বে অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। টিআইবি বলছে, সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন জুয়া বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto