সাদাপাথর কেলেঙ্কারি

♦ নান্দনিক স্থান এখন বিরানভূমি ♦ নীরব প্রশাসন, ছিল রাজনৈতিক মদতও ♦ লুটপাট সম্পন্ন হওয়ার পর সভা ডেকেছে জেলা প্রশাসন
নদীর বুকে সাদা পাথরের স্তর। পাথরের গা ভিজিয়ে বয়ে চলছে ধলাই নদী। সীমান্তের ওপারে সারি সারি পাহাড়। পাহাড়, পাথর আর জলধারার অপূর্ব মিতালি দেখতে প্রতিদিন হাজারো প্রকৃতিপ্রেমী ছুটে আসতেন সিলেটের সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে। সেই নয়নাভিরাম সাদা পাথর এখন লুটের রাজ্য। গেল বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে শুরু হয় পাথর লুট। সেই লুটের ষোলকলাপূর্ণ হয়েছে সম্প্রতি। ওপারে ঠায় দাঁড়িয়ে আাছে ভারতের মেঘালয় পাহাড় ওপারে বইছে ধলাই। কিন্তু সূর্যের আলোতে চিকচিক করা সেই সাদা পাথর আর নেই। পর্যটন কেন্দ্রটি এখন যেন কঙ্কালসার বিরানভূমি। এক বছর ধরে সাদা পাথর লুটের মহোৎসব চললেও প্রশাসন ছিল নীরব। শত কোটি টাকার পাথর লুট হলেও নিজেদের কোনো ব্যর্থতা খুঁজে পাচ্ছে না প্রশাসন। লুটপাট সম্পন্নের পর করণীয় ঠিক করতে আজ (বুধবার) সভা আহ্বান করেছে জেলা প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, সাদা পাথর লুটে ছিল রাজনৈতিক মদতও। লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগে সোমবার রাতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করা হয়েছে।
সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম সাদা পাথর। ভারতের সীমান্তঘেঁষা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে অবস্থান পর্যটন কেন্দ্রটির। আদালত ও খনিজ সম্পদের নিষেধাজ্ঞায় গেল কয়েক বছর ধরে সাদা পাথর থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ ও সরকার পতনের পর সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে সাদা পাথর থেকে কয়েক শ কোটি টাকার পাথর লুট হয়। অভিযোগ ওঠে এই লুটে বিএনপির স্থানীয় কতিপয় নেতার মদত ছিল। এ সংক্রান্ত সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ ও পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হলে লুটপাট কিছুটা থামে। এর মধ্যে পরিবেশ এবং খনিজসম্পদ উপদেষ্টা সিলেট ঘুরে সব পর্যটন কেন্দ্র থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এরপর কয়েকদিন পাথর ভাঙার মেশিন উচ্ছেদে অভিযান চালায় টাস্কফোর্স। কিন্তু বন্ধ হয়নি পাথর লুট। গেল কয়েকদিন ধরে পাথরখেকোরা ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠে। লুটে নেয় সাদা পাথরের সব পাথর।
সরেজমিন দেখা গেছে, সাদা পাথর এলাকা এখন পাথরশূন্য। ধলাই নদীর বুকজুড়ে পাথরখেকোদের খাবলে খাওয়ার চিহ্ন। নদীর তলদেশে জমা হওয়া পাথর লুটের পাশাপাশি মাটির নিচে গভীর গর্ত করেও তারা লুটেছে পাথর। গর্ত আর লুটের চিহ্ন কঙ্কালসার বিরানভূমিতে পরিণত করেছে সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রকে। পাথর লুটের কাহিনি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর ‘হুঁশ’ ফিরেছে প্রশাসনের। গতকাল সাদা পাথর এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশের অবস্থান দেখা গেছে। যদিও আগের রাতে উপজেলা বিএনপির সভাপতির পদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পর লুটপাটকারীদের খুব কমই দেখা গেছে সাদা পাথর এলাকায়।
এদিকে পাথর লুটের জন্য প্রশাসন ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতার মদতদানের অভিযোগ তুলেছেন পরিবেশবাদীরা। সিলেটে কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে ডাকা হয়েছিল পরিবহন ধর্মঘট। সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বিভাগীয় কমিশনারের দেওয়া বক্তব্য নিয়েও নাখোশ ছিলেন পরিবেশবাদীরা। এ ছাড়া পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে নগরীতে অনুষ্ঠিত হয় মিছিল-সমাবেশ ও মানববন্ধন। এসব কর্মসূচিতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা অংশ নিয়ে দাবির প্রতি একাত্মতা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদীরা মনে করেন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের আশকারা পেয়েই পাথরখেকোরা বেপরোয়া হয়েছে।
সাদা পাথর লুট হলেও এতে প্রশাসনের কোনো ব্যর্থতা ছিল না বলে মনে করেন সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ। তিনি বলেন, ‘সাদাপাথর রক্ষায় প্রশাসনের কোনো গাফিলতি ছিল না। লুটপাট বন্ধ এবং নতুন করণীয় নির্ধারণে আগামীকাল (বুধবার) সভা আহ্বান করা হয়েছে। ওই সভা থেকে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল এবং লুটপাট বন্ধে আগামীতে কী করা উচিত তা নির্ধারণ করা হবে।’