Hot

সামনে সংঘাত না নির্বাচন?

বিদেশি বিনিয়োগ ও অর্থনীতি বাঁচাতে ঈদের আগেই ‘নির্বাচনী রোডম্যাপ’ জাপানে নিক্কেই ফোরামে ‘সব রাজনৈতিক দল নয়, শুধু একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়’ বক্তব্যে তোলপাড় * ভারতের চার নোবেল-বিজয়ী ‘সম্মাননা’ মনে করলেও ড. ইউনূস ‘নোবেল পুরস্কার’ ব্যবসায়িক পুঁজি করেছেন * বিএনপি ভারতের সুরে কথা বলেÑ বিশ্বাসযোগ্য নয়; তবে দলটিকে জিয়াউর রহমানের আদর্শে ফিরতে হবে

১০ মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকারের চিত্রটা যেন ‘কামরূপ কামাখ্যা’র গল্পের মতো। ভারতের আসাম রাজ্যের কামরূপ কামাখ্যার অরণ্যঘেরা নির্জন পথে নাকি ঘুরে বেড়ায় মন্দ আত্মারা। কোনো পুরুষ সেখানে একবার গেলে নাকি ফিরে আসে না। নারীরা রাজত্ব করেন। কালেভদ্রে কোনো পুরুষ কামরূপ কামাখ্যায় পা রাখলে ফেরে না, জাদু করে রাখা হয়। পুরুষকে ছেড়ে দেয়া হলে সারাদিন হাঁটার পর সন্ধ্যায় দেখা যায়, তিনি যে স্থান থেকে হাঁটা শুরু করেছেন ঘুরেফিরে সেখানেই পৌঁছেছেন। শিশু ভোলানো এই আধ্যাত্মিক জাদুকরি কাহিনী যেন এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ভর করেছে। শেখ হাসিনা পালানোর পর গণতন্ত্র, জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথচলা শুরু হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা গত বছরের বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন, ‘নির্বাচনী ট্রেন চলতে শুরু করেছে, এ ট্রেন আর থামবে না।’ কিন্তু উপদেষ্টাদের কথাবার্তা, সংস্কার নিয়ে মায়াকান্না দেখে মনে হচ্ছেÑ নির্বাচনের ট্রেন যে স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করেছে এখনো সেখানেই রয়ে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূরীকরণে দ্রুত নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ অপরিহার্য। অথচ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কিছু দিন পরপর ঢাকঢোল পিটিয়ে সংলাপ, ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ অর্ধশতাধিক দলের কঠোর অবস্থান, সেনাপ্রধানের ‘ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে’ বক্তব্যকে ভ্রুক্ষেপে নেয়া হচ্ছে না। সঙ্কট সমাধানে প্রধান উপদেষ্টা সংলাপ করছেন কিন্তু সঙ্কট সুরাহার বদলে কামরূপ কামাখ্যার গল্পের জাদুতে আটকে যাওয়া পুরুষের মতো নির্বাচন ইস্যু আটকে আছে। এত সংলাপ, এত আলোচনা তার পরও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরা পুরোনো অবস্থান ‘ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনে’র মধ্যে নির্বাচন সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়ছেন না। প্রশ্ন হচ্ছেÑ সরকার যদি ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের সিদ্ধান্তে স্থির থাকে তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যমুনায় ‘সংলাপ নাটক’ প্রয়োজন কেন?

বর্তমান চলছে সোশ্যাল মিডিয়া উত্থানের যুগ। যা ঘটে-রটে সবটাই সোশ্যাল মিডিয়ায় চাউর হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার নেটিজেনদের অনেকেই বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ কার্যত সময়ক্ষেপণ। উপদেষ্টাদের কয়েকজন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে সংস্কার অজুহাত দেখাচ্ছেন। কেউ জনগণ পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চায়Ñ প্রচার করছে। যদিও প্রধান উপদেষ্টা ‘স্বল্প সংস্কারে ডিসেম্বর বেশি সংস্কারে আগামী বছরের জুন’ নির্বাচনের কথা বলেছেন। কিন্তু বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ যতই দীর্ঘ হবে, ভারতীয় ষড়যন্ত্র ততই গতি পাবে। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ না এলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হবে। সে কারণে বিএনপিসহ ৫২টি দল স্বল্প সংস্কার করে ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবি করছে। বিএনপিকে ‘ডিসেম্বরে নির্বাচন’ দাবি থেকে ভুলিয়ে রাখতে মাঝে মাঝেই ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংলাপ’ আয়োজন করা হয়। যে সংস্কার ও হাসিনার বিচারের অজুহাতে নির্বাচন পেছানোর বায়না ধরা হচ্ছে সেগুলো এগোচ্ছে খুবই সম্ভুক গতিতে।

নির্বাচন ইস্যুতে ইউটিউব চ্যানেলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলছেন, ছাত্ররা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলোÑ সেনাবাহিনী ও বিএনপি সমর্থন না দিলে অন্তর্বর্তী সরকার ২৪ ঘণ্টাও টিকে থাকতে পারবে না। সেনাবাহিনীর প্রধান বলেছেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়া উচিত এবং বিএনপিও চায় ডিসেম্বরে নির্বাচন। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরা পুরোনো বক্তব্য ‘ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনে’র মধ্যে নির্বাচন হবে সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। সেনাবাহিনী ও বিএনপির সঙ্গে সরকার বিরোধে জড়িয়ে কী বার্তা দিতে চাচ্ছে?’

সিনিয়র সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নেতা এম এ আজিজ সম্প্রতি একাধিক টিভি টকশোতে বলেছেন, নোবেল-বিজয়ী প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশটা তথা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে বাণিজ্যক্ষেত্র মনে করছেন। তিনি তার নিজের ব্যবসা গ্রামীণ ব্যাংকের মতোই সবকিছু নিয়ে ব্যবসা করতে চাচ্ছেন। প্রধান উপদেষ্টা চারটি দেশের নাগরিক। উপদেষ্টা পরিষদ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন এমন ১৭ জন বিদেশি নাগরিক। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া নিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা কেবল একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে সম্ভব। এত রক্ত দিয়ে ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত দেশকে ব্যবসাক্ষেত্র বানানোর জন্য করেনি। আর প্রধান উপদেষ্টা যেভাবে ছাত্ররা ক্ষমতায় বসিয়েছে বলছেন এবং এনসিপির জন্য নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করছেন তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। নির্বাচন হলে এনসিপি ক্ষমতায় আসা দূরের কথা, দু’-চারটি আসনও পাবে না। আর বিএনপিকে কোণঠাসা করতে জামায়াত যে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে, নির্বাচনের পর জামায়াত দু’-চার আসন পেলেও তাদের এখনকার অবস্থা থাকবে না।

প্রবাদে রয়েছেÑ ‘ক্ষমতা বিবেকবান মানুষকে অন্ধ করে দিতে পারে না। কিন্তু লোভ-লালসা মানুষকে অন্ধ ও নির্বোধ করে দেয়! তবে ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষের প্রকৃত চরিত্রের প্রকাশ ঘটে।’ নোবেল-বিজয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কি ক্ষমতা অন্ধ করে দিলো? এ প্রশ্ন উঠেছে তার জাপান সফরে গিয়ে নিক্কেই ফোরামে ফিউচার অব এশিয়া শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘কেউ কেউ সংস্কার রেখে ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চাইছে। সব রাজনৈতিক দল নয়, শুধু একটি দল এটা বলছে।’ তিনি মূলত একটা দলÑ বিএনপি বুঝিয়েছেন। তার এ বক্তব্য নিয়ে নেট জুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে গেছেন? বাস্তবতা হচ্ছেÑ বিএনপি ও দলটির সমমনা ৪২টি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। এ ছাড়াও সিপিবি-গণফোরাম-জাসদ-বাসদসহ অন্যান্য ১০টি দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। তাহলে ড. ইউনূস কি অন্যান্য দলগুলোকে রাজনৈতিক দল মনে করছেন না? তার কাছে নিবন্ধনহীন এনসিপি আর জামায়াত অতি গুরুত্বপূর্ণ দল? হাসিনা রেজিমে নোবেল-বিজয়ী ড. ইউনূসের উপর রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে চরম অন্যায় ও জুলুম হয়েছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে নোবেলের জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ করেও নোবেল পেতে ব্যর্থ হন শেখ হাসিনা। সে কারণে দেশের একমাত্র নোবেল-বিজয়ী ড. ইউনূসকে টার্গেটে পরিণত করা হয়। ক্ষুদ্রঋণের কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের জনক ড. ইউনূসকে ‘সুদখোর’ হিসেবে প্রচার করেন শেখ হাসিনা ও তার অলিগার্ক গণমাধ্যম। দেশের মানুষ ড. ইউনূসের প্রতি নির্দয় না হলেও ঋণের সাপ্তাহিক ও মাসিক কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ গরিব ঋণগ্রহীতাদের ঘরের টিন খুলে নেয়া ও গরু ছাগল হাঁস মুরগি ধরে নিয়ে আসতো গ্রামীণ ব্যাংক। এসব খবর গণমাধ্যমে প্রচার হতো। যার কারণে মানুষ হাসিনার ‘ঘুষখোর ড. ইউনূস’ শব্দকে গুরুত্ব না দিলেও ড. ইউনূস সমাজে ‘রক্তচোষা ঘুষখোর’ হিসেবে পরিচিতি পান। ভারতের সহায়তায় দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে শেখ হাসিনা সব সময় ড. ইউনূসকে টার্গেট করেছেন। ২০১২ সালে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা ভয়ঙ্করভাবে ইউনূসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেন। অন্যদিকে বিএনপি ড. ইউনূসকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। সে সময় বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ড. ইউনূসের পক্ষ নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। হাসিনা ও তার সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বেগম জিয়া বলেন, যে জাতি গুণীজনকে সম্মান দিতে জানে না, সে জাতি বড় হতে পারে না। ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, তাকে এভাবে হেনস্তা করা মেনে নেয়া যায় না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করছি, নিন্দা জানাচ্ছি।’ বেগম খালেজা জিয়ার সেই বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। সেই খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে কয়েক দিন আগে দেশে ফিরে এসেছেন; অথচ তাকে একবারও দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি ড. ইউনূস। অথচ রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমার যতই ড. ইউনূসের পক্ষে অবস্থান নিক; সেনাবাহিনী ও বিএনপির সমর্থন ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার ২৪ ঘণ্টাও ক্ষমতায় টিকতে পারবে না।’

নোবেল পুরস্কার বিরল সম্মানের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর গত তিন দশকে ভারতসহ উপমহাদেশে আরো কয়েকজন নিজ নিজ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। এদের মধ্যে ১৯৯৮ সালে ড. অমর্ত্য সেন, ২০০৯ সালে ভেঙ্কটরাম রামকৃষ্ণ, ২০১৪ সালে কৈলাস সত্যার্থী ও ২০১৯ সালে অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। এর বাইরে অং সান সুচিসহ অনেকেই নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু কেউ-ই নোবেল পুরস্কার ‘ব্যবসার পুঁজি’ হিসেবে ব্যবহার করেননি। অথচ ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কারের নাম ভাঙিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে বিশ্বের দেশে দেশে বাণিজ্যের প্রসার বাড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রবন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার জনমত গঠনে তার বক্তব্য সে বার্তাই দেয়।

নির্বাচন নিয়ে বিলম্বের মূল কারণ হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া দলটি চায় নির্বাচন পেছাতে। সাংগঠনিকভাবে সুসংগঠিত হতে নতুন দলটির দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। আর জামায়াত ও এবি পার্টির মতো দলগুলো কখনো আগে নির্বাচন কখনো সংস্কারের পর নির্বাচন খেলছে। সে দু’দলকে অন্তর্বর্তী সরকার অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সেই জামায়াত ও এনসিপি অনিবন্ধিত দল। সংলাপে সবার পরের সারিতে তাদের থাকার কথা। কিন্তু সরকার তাদের গুরুত্ব দেয় বেশি। অথচ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের তালিকায় এক নম্বরে এলডিপি। সে দলকে রাজনৈতিক দল মনে করছেন না প্রধান উপদেষ্টা? যে ৫২টি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নিবাচন দাবি করছে এদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। অথচ ‘ডিসেম্বরে একটি দল নির্বাচন চায়’ বলার হেতু কি?

এ নিয়ে সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না তার ইউটিউব চ্যানেলে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘একজন নোবেল-বিজয়ী কথায় কথায় ‘মিথ্যা’ বলেন কেমন করে? আমি মিথ্যা শব্দ ব্যবহারের বদলে বলছি ড. ইউনূস ব্যবসার জন্য প্রভাবিত হয়ে অসত্য কথা বলছেন। ক্ষমতায় থেকে তিনি এনসিপিকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। তাদের আর্থিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কথায় কথায় তিনি দাবি করেন, এনসিপির তরুণরা তাকে ক্ষমতায় বাসিয়েছে। যার জন্য তিনি এনসিপির স্বার্থরক্ষায় নির্বাচন পরে করার পক্ষে। অবশ্য ড. ইউনূস এর আগে আল জাজিরায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চায়। শুধু কি তাইÑ অনেকেই বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারলে ড. ইউনূসকে জাতিসংঘের মহাসচিব করা হতে পারে।’

ড. ইউনূস গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করায় মানুষ খুশিই হয়েছিল। কারণ ভারত যেভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ষড়যন্ত্র করছে তাতে মানুসের ধারণা ছিলÑ ড. ইউনূসই কেবল সেটার প্রতিরোধ করতে পারেন। প্রথম দিকে সেটি দেখাও গেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন এনজিও মার্কা উপদেষ্টা এবং ভারত ও পশ্চিমা ঘেঁষা উপদেষ্টা তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে ‘ক্ষমতা লোভাতুর’ করে তোলে। এখন তিনি এসব কিছু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। ‘ব্যবসা-বাণিজ্য আর রাষ্ট্র’ যে এক জিনিস নয়, সেটি তিনি গুলিয়ে ফেলেছেন। তবে তিনি নিজের ব্যবসা ও স্বার্থ ভালোই বোঝেন। তার মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত দেশ গড়ার কারিগর হতে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানানোর কথা। কিন্তু তিনি সেটি না করে সবাইকে উদোক্তা হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
নিক্কেই ফোরামের ওই প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি লক্ষ্যে কাজ করছে। সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। প্রশ্ন হচ্ছে তিন লক্ষ্যের কোনটিতে তিনি সফলতা দেখিয়েছেন? সংস্কারের নামে সংলাপ নাটক হচ্ছে। কিছু কিছু বিষয় সংস্কারের প্রস্তাবনা করা হয়েছে যা দেশের সঙ্গে বেমানান। আর ফ্যাসিস্টদের বিচার? দেশের সম্পদ লুষ্ঠনকারী শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার ১০ মাসে তেমন এগোয়নি। জাতিসংঘের অনুসন্ধানে বলা হয় গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৪ শ’ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা। কিন্তু ভারতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি কি আহ্বান জানিয়েছেন? তিনি এখন হাসিনা ও তার আত্মীয়-স্বজনদের প্লট, ফ্ল্যাট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। বিদেশ যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞ জারি করা হচ্ছে। যারা আগেই ব্যাংকের টাকা উঠিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন তাদের অ্যাকাউন্ট জব্দ আর বিদেশে যেতে বিধিনিষেধ কি লোক দেখানো?

মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশে বাওয়ানী, আদমজী, করিম জুট মিল থেকে শুরু করে খুনলা, যশোরসহ সারাদেশে শত শত মিলকারখানার মালিক ছিল পাকিস্তানিরা। দেশ স্বাধীনের পর সবগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর হাসিনার অলিগার্কদের কতগুলো সম্পদ নেয়া হয়েছে? হাসিনা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে পালিয়ে গেছেন। গত ১০ মাসে অর্থনীতি কি কোমড় তুলে দাঁড়াতে পেরেছে? বিদেশি বিনিয়োগকারী আনা গেছে? প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। তার উপর ভর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ছে। কিন্তু বিনিয়োগ আসছে না। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ঢাকায় আনা হলেও তারা বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন; তবে অনির্বাচিত নয়, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা বিনিয়োগ করবেন বলে বার্তা দিয়েছেন। ফলে কোমড় ভেঙে যাওয়া অর্থনীতিকে সোজা করে দাঁড়ানো এবং গতিশীল করতে ঈদের আগেই নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। কারণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন করার সম্ভব। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে।’ দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর পর ২৯ মে প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতায় বিএনপির চেয়াপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা আজো প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খুব শিগগিরই আমরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাবো।’

বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বার্তা পরিষ্কার। অন্তর্বর্তী সরকার ঈদের আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে বিএনপি মাঠে নামবে। নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি মাঠে নামলে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সেটি হবে অশনি সঙ্কেত। বিএনপি দীর্ঘ ১৫ বছর আন্দোলন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি বটে কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের কাঁপুনি তুলেছিল। তারেক রহমান বিদেশে থেকে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বেগম জিয়া কারাগারে থাকায় দলের নেতৃত্ব দিতে পারেননি। তারপরও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে ভয়ভীতি দেখিয়ে, আক্রমণ, হামলাÑ মামলা, গুম-খুন করে, মন্ত্রী-এমপির প্রলোভন দেখিয়ে বিএনপিকে খ-বিখ- করা যায়নি। এখন সব মামলায় মুক্তি পেয়ে তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব দেবেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ‘ডিসেম্বরে নির্বাচন’ দাবিতে আন্দোলনের ডাক দিয়ে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা সহজেই অনুমেয়। তবে বিএনপিকেও জিয়ার আদর্শের পথে হাঁটতে হবে। কারণ ভারতের নাচের পুতুল শেখ হাসিনা দিল্লির চানক্যনীতি কৌশলে ‘নির্বাচন নাটক’ করে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকলেও দেশের মানুষ আগামীতে ভারতঘেঁষা দলকে ভোট দেবে না। গত কয়েক মাসে ভারতীয় পণ্য বর্জন, চিকিৎসার জন্য রোগীর চীনমুখী হওয়া এবং পর্যটকদের ভারতের বদলে থাইল্যান্ড, মালদ্বিপ, ভুটান যাওয়ার হিড়িক দেখে সেটি বোঝা যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় জামায়াত, এনসিপি ব্যাপক প্রচারণা চালালেও ভোটের রাজনীতিতে দল দু’টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। বিএনপি জনগণের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় দল। তবে দলটির তথাকথিত ‘প্রগতিশীল চেতনা’ বদলে জন্মলগ্নের জাতীয়তাবাদী ইসলামী মূল্যবোধ চেতনায় প্রত্যাবর্তন সময়ের দাবি। কারণ দেশের ইসলামী ধারার ছোট দলগুলোর কর্মী-সমর্থকরা ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির অনুসারী। তাদের কাছে টেনে নিতে হলে ভারতীয় জুজুমুক্ত হতে হবে।

জানতে চাইলে ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের আমির ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী ইনকিলাবকে বলেন, আমরা বিএনপিকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দল মনে করি। কিন্তু বর্তমান বিএনপি জিয়ার আদর্শ থেকে সরে গেছে। যার কারণে ইসলামী ধারার দলগুলো বিএনপির কাছাকাছি হচ্ছে না। কাছাকাছি নেই বলে যে ভবিষ্যতে কাছাকাছি হবে না সেটি নয়। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যাইনি। বিএনপির উচিত জিয়ার আদর্শকে ধারণ করা। বিএনপির বর্তমান দায়িত্বশীল নেতাদের ইসলামী আদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তব্য আসতে হবে। আমরা ছোট দল বিএনপিকে ডাকতে পারি না। বড় দল হিসেবে বিএনপিকেই ইসলামী ধারার দলগুলোকে ডাকতে হবে। শুধু ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলে হবে না। ডিসেম্বরে তো ভারতও নির্বাচন চাচ্ছে। তাহলে কি বিএনপি ভারতের সঙ্গে সুর মেলালো? আমরা সেটি মনে করি না। ইসলামী দলগুলো ইসলামের উপর রয়েছে। শেখ হাসিনা মোনাফেকি করলেও তিনি ইসলামী দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করেছেন। অথচ বিএনপি নেতাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তারা ফ্যাসিবাদের চেয়েও জঘন্য ফ্যাসিবাদী। জিয়া সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ শব্দগুলো যোগ করেন। সে কারণে বিএনপির প্রতি আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য হচ্ছেÑ শক্তিতে আমরা দুর্বল হলেও ইসলামী ধারার দলগুলো ইসলামের পক্ষে থাকবে; অন্য কোনো শক্তির সঙ্গে নয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d