Hot

সারছে অর্থনীতির ক্ষত, অস্বস্তি বাজারে

আর্থিক খাতের প্রবল সংকট আর সমালোচনার মধ্যেই গণঅভ্যুত্থানে ধসে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকার। স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে এসে সাধারণ মানুষের জানবার ইচ্ছা, অর্থনীতির অবস্থা এখন কেমন। মানুষ জানতে চায়, সরকার কী করছে, কী করতে চায়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর– চারজনই স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ায় আর্থিক খাত নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা একটু বেশি।

হাসিনা সরকারের আমলে বড় বড় দুর্নীতি হয় আর্থিক খাতে। ব্যাংক খাতের ক্ষত ছড়িয়ে পড়ে পুরো অর্থনীতিতে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্থিক খাত ‘মরমর’ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অস্থির ডলার বাজারে ফিরেছে কিছুটা স্বস্তি। প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্সে এসেছে গতি। রপ্তানিও এখন ইতিবাচক ধারায়। তবে পণ্য বাজারে যে অস্বস্তি ছিল, তা কাটেনি। মানুষ বাজারে গিয়ে দামের চোটে হচ্ছে নাকাল। বাজারের পাশাপাশি কর্মসংস্থান নিয়েও রয়েছে মানুষের উদ্বেগ। আর উদ্যোক্তারা এখনও নতুন বিনিয়োগে তেমন এগিয়ে আসছেন না। তারা ব্যবসায়িক পরিবেশের বিশেষত আইনশৃঙ্খলার আরও উন্নতি চান। অন্যদিকে, সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে রয়েছে এক ধরনের স্থবিরতা।

এদিকে মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানোর নীতিকে সমর্থন করছেন না ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এতে মূল্যস্ফীতি কমছে না। অন্যদিকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হালনাগাদ পরিসংখ্যান না থাকলেও বিনিয়োগকারীরা বলছেন, কর্মসংস্থানের গতি ধীর হয়ে গেছে। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্যও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।

ব্যাংক খাতে ভঙ্গুরতা নিয়ে আলোচনা চলছিল কয়েক বছর ধরে। তবে গত সরকারের সময়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং নানা উপায়ে প্রকৃত চিত্র করা হয়েছে আড়াল। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোতে নজিরবিহীন ঋণ অনিয়ম হয়েছে। এসব ব্যাংক এক পর্যায়ে তারল্য সংকটে পড়ে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাব ঘাটতি রেখে লেনদেনের সুযোগ দিয়ে সংকট ধামাচাপা রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল।

ব্যাংক খাত কোন দিকে
বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা সাতটিসহ ১১ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিয়েছে। আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা উদ্ঘাটন ও ব্যাংক খাত সংস্কারে তিনটি টাস্কফোর্স গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এদিকে সরকার অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জানাতে এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান অগ্রাধিকার বিবেচনায় বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন করে সরকারকে ঋণ না দিয়ে উল্টো আগের দেনা পরিশোধ করা হচ্ছে। আবার ডলার সংকটের দোহাই দিয়ে কেউ যেন পণ্যের দর বাড়াতে না পারে, সে জন্য কেউ ডলার না পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে।

ডলার বাজারের অস্থিরতা এখন কমেছে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্স ৩০ শতাংশ বাড়ায় ডলারের সংকট কমাতে সহায়তা করেছে। রেমিট্যান্সে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির এখনকার সবচেয়ে বড় সুখবর। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম কিছুদিন শ্রমিক আন্দোলন ঘিরে অস্থিরতা রপ্তানির ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করেছিল। এখন রপ্তানি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি বেড়েছে ১১ শতাংশ। গত অর্থবছরে রপ্তানি ৫ শতাংশ কমে যায়। বিনিময় হার বাজারমুখী করার সিদ্ধান্ত  রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়ার মূল কারণ। ঋণ পরিশোধের বড় চাপ থাকার পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মোটামুটি স্বস্তিদায়ক রয়েছে। দ্রুত কমে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করা গেছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো বৈশ্বিক সংস্থা থেকে পাওয়া গেছে কম সুদের ঋণ পাওয়ার বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি। ফলে আগামীতে ডলার বাজার ও রিজার্ভ আরও স্থিতিশীল হওয়ার আশা করছে সরকার।

ধারণা করা হচ্ছে, নতুন করে অর্থ পাচার কমেছে। অর্থ পাচারকারীকে চিহ্নিত করতে এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো সংস্থার সহায়তা নিচ্ছে সরকার। অর্থ ফেরত আনতে কমিশনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ হচ্ছে।

দ্রব্যমূল্য মূল উদ্বেগের জায়গা
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েক দফা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে দ্রব্যমূল্য কমাতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এসব সিদ্ধান্তের আলোকে এরই মধ্যে এনবিআর চাল, পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যে শুল্ক কমিয়েছে। পণ্যের দরের লাগাম টানতে সক্রিয়ভাবে বাজার তদারকি, ডিলার ও মিল মালিকদের পণ্য সরবরাহে উৎসাহিত করতে জেলা প্রশাসকরাও ভূমিকা নেবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পণ্যের অবৈধ মজুত ঠেকাতে  নজরদারি এবং কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলা হয়। এসব উদ্যোগের পরও এর প্রভাব খুচরা বাজারে তেমন নেই। বরং আলু, পেঁয়াজসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এসব পণ্যের দর বাড়ায় স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত আগস্টে খাদ্য খাতে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে তা ছিল ১০ দশমিক ৪০ আর অক্টোবরে হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমদানি পর্যায়ে নিত্যপণ্যের শুল্ক কমানো হলেও বাজার বিশৃঙ্খলার কারণে পণ্যের দাম কমছে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষ অধৈর্য হয়ে গেছে। মানুষের কষ্ট হচ্ছে। ৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে দু’মুঠো শাক, অন্যকিছু কিনতেই শেষ। দাম কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে বাজারে দাম কমানো শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়।

বাজেট কমাতে চায় সরকার 
মূল্যস্ফীতি কমাতে ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে খরচ কমানোর নীতি নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় রোধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ব্যয়ের পরিকল্পনায় বড় অঙ্কের কাটছাঁট করতে যাচ্ছে সরকার। প্রাক্কলিত ব্যয় ১ লাখ কোটি টাকার মতো কমতে পারে। তবে পরিচালন বাজেট ছাঁটাইয়ের সুযোগ কম। তাই বেশির ভাগ কাটছাঁট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে হবে। কিছু প্রকল্পের বরাদ্দ কমানো হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের একনেকের প্রথম বৈঠকেই এডিপিভুক্ত সব উন্নয়ন প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকার মনে করে, প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এডিপিতে এমন অনেক প্রকল্প আছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এলাকার নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে নেওয়া হয়েছে। কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব ও ঠিকাদারের স্বার্থে। এদিকে সরকার পরিবর্তন এবং আগে-পরের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে এই অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত অর্থবছরের একই সময়ের প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। মাত্র ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যা গত ১৩ অর্থবছরের একই সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন।

আশা জাগিয়েও দিশাহীন শেয়ারবাজার
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরে শেয়ারবাজারের পালে লেগেছিল হাওয়া। মাত্র চার দিনের উত্থানে শেয়ারবাজারে সূচক বেড়েছিল ৭৮৬ পয়েন্ট। তবে মাঝে উল্টো হাওয়ায় টানা প্রায় আড়াই মাসের দর পতনে  বিনিয়োগকারীর পকেট শূন্য হওয়ার দশা হয়। পরিস্থিতি সামলাতে সরকার এগিয়ে আসায় পতনের ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে শেয়ারবাজার। তবে সবটা ঠিক হয়ে গেছে বলা যাবে না।

হাসিনা সরকারের সময় শেয়ার কারসাজির বড় ঘটনাগুলো নিয়ে তদন্ত শুরু হলে জড়িতদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায় এবং তারা শেয়ার কেনাবেচায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ফলে হঠাৎ ক্রেতা চাহিদা কমে যায়। কিছু ক্ষেত্রে তাদের শেয়ার বিক্রি বাজারে দর পতনকে উস্কে দেয়। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম দুর্নীতির কারণে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে থেকে পদ ছাড়েন। ফলে সরকার সংস্থাটির শীর্ষ নেতৃত্বে বদল আনে। পুনর্গঠিত বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে শুরুতে বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলে দর পতন মাত্রা ছাড়ায়। নিয়োগের এক মাসের মধ্যে বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ হয়। 

পরিস্থিতি সামাল দিতে খোদ অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের বার্ষিক সভায় অংশ নিয়ে দেশে ফিরেই বিএসইসি কার্যালয়ে গিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। এর পরই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জসহ বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু সুপারিশ জানালে তা মেনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে মূলধনি মুনাফায় করহার সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে সরকার। এ ছাড়া আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্যারান্টি দেওয়ার ঘোষণা করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে দর পতন বন্ধ হয়েছে। তবে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক– এমনটা মনে করছেন না শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টরা।

শ্রম অসন্তোষ নিরসনের নেপথ্যে সরকার
প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই যে শ্রম অসন্তোষ শুরু হয়, তা নিরসনে সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা ছিল। শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিতে উস্কানি, বহিরাগতদের অংশগ্রহণে  সাভারের আশুলিয়া এবং গাজীপুরের বেশ কয়েকটি  কারখানা হামলা-ভাঙচুর হয়। প্রায় দুই মাসের মতো অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ থাকে। এ অচলাবস্থার মধ্যে মালিক এবং শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৮ দফার একটি যৌথ ইশতেহারের ঘোষণায় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। এ ইশতেহারের নেপথ্যে ছিল শ্রম মন্ত্রণালয়। নতুন করে আর শ্রম অসন্তোষ না হলে আগামী দিনেও রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকতে পারে।
 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d