সাহায্য প্রতিশ্রুতি ৫৮.৫০ শতাংশ হ্রাস : দায় মেটাতে চাপের মুখে সরকার

রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছিল অর্থনীতি
উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতিতে চরম খরা ধরেছে। দেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগী বা দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি আগের অর্থবছরের তুলনা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) ৯ মাসে ৫৮.৫০ শতাংশ বা ৪২৩ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার ডলার কমে গেছে। পাশাপাশি ছাড় কমেছে ১৪.৬১ শতাংশ বা ৮২ কোটি ২৭ লাখ ডলারের বেশি। কিন্তু দায় পরিশোধ ৬৪ কোটি ৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার বেড়েছে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা গেছে। আর সহায়তা ছাড়করণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) শীর্ষে থাকলেও প্রতিশ্রুতিতে এগিয়ে বিশ্বব্যাংকের আইডি। তবে বাজেটে প্রকল্প সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৩০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সহায়তা কমে যাওয়ার ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছিল গত ৯ মাস বাংলাদেশের অর্থনীতি। বাস্তবায়নে অগ্রগতি কমেছে। প্রকল্প গ্রহণও কমেছে। আগে রাজনৈতিকভাবে প্রকল্প নেয়া হতো। যার কারণে প্রতিশ্রুতি ও অর্থ ছাড় স্বাভাবিকভাবে কমবেই।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইআরডির সদ্য প্রকাশিত তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট থেকে সহায়তা পাবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় এক হাজার ৮২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল বাজেটে সহায়তা প্রাপ্তির সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হলো ৯৩০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। যেখানে আমেরিকা ও জাপান ১৮৮ কোটি ২০ লাখ ডলার, বিশ্বব্যাংক (আইডিএ) ২২৫ কোটি ডলার, অ্যাডমিন ও মধ্যপ্রাচ্য ১৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার, জাতিসঙ্ঘ ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৯৫ কোটি ২০ লাখ ডলার, সমন্বয় এবং নর্ডিক ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার, ইউরোপ থেকে ১৩১ কোটি ৯০ লাখ ডলার, এশিয়া, জেইসি এবং এফঅ্যান্ডএফ থেকে ১৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলার ধরা হয়েছে।
প্রতিশ্রুতির বিপরীতে কার কত ছাড়
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রতিশ্রুতি ছিল ৩০০ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। যার বিপরীতে ছাড় হয়েছে ৪৮০ কোটি ৮৮ লাখ ২০ হাজার ডলার। এই ছাড় চলতি সময়ের প্রতিশ্রুতির চেয়ে বাড়লেও আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী হলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ৯ মাসে সংস্থাটি ৭০ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে দিলো ১২২ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। বিশ^ব্যাংকের আইডিএ প্রতিশ্রুতির ৯৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের বিপরীতে দিয়েছে ১০৬ কোটি ৭৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এআইআইবি ১৬ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার, জাপান ৮৩ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার ডলারের বিপরীতে ৮৯ কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার ডলার, ভারতের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। তবে ছাড় করেছে ১৩ কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার, চীনেরও প্রতিশ্রুতি নেই। ছাড় করেছে ৩২ কোটি ৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার, রাশিয়াও প্রতিশ্রুতিহীন ৬৭ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার ছাড় করেছে। ভারত, চীন ও রাশিয়া পুরনো প্রতিশ্রুতি থেকে অর্থ ছাড় করছে। অন্যান্য দাতা দেশ ও সংস্থার দেয়া ৩৬ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ছাড় করেছে ৪২ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার ডলার।
আগের তুলনায় প্রতিশ্রুতি ৫৮.৫০ শতাংশ কম
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা এসেছে ৩০০ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। যা আগের অর্থবছর একই সময়ে ছিল ৭২৪ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ফলে প্রতিশ্রুতি কমেছে ৪২৩ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার ডলার। যা ৫৮.৫০ শতাংশ। এ বছর প্রতিশ্রুতিতে অনুদানের পরিমাণ ৩৩ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার ডলার এবং ঋণ ছিল ২৬৬ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
অর্থছাড় কমেছে ১৪.৬১ শতাংশ
চলতি অর্থবছর উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থ ছাড় করেছে জুলাই-মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে মোট ৪৮০ কোটি ৮৮ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। যার মধ্যে অনুদান হলো ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং ঋণ ৪৪৭ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার। যেখানে আগের অর্থবছর একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ৫৬৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। সেখানে অনুদান ছিল ৩০ কোটি ৮৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার এবং ঋণ ৫৩০ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার ডলার। ফলে গত বছরের তুলনায় অর্থছাড় ১৪.৬০ শতাংশ কম হয়েছে। যা ৮২ কোটি ২৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
দায় পরিশোধে চাপ বাড়ছে
ইআরডির মার্চ পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশকে সুদ ও আসল বাবদ ৩২১ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার ডলার উন্নয়ন সহযোগীদেরকে পরিশোধ করতে হয়েছে। যার মধ্যে আসল বাবদ ২০১ কোটি ১০ লাখ ৭০ হাজার ডলার এবং ঋণের সুদ ১২০ কোটি ১০ হাজার ডলার। সুদ হলো মোট পরিশোধের ৩৭.৩৯ শতাংশ। আর আগের বছর সুদাসলে পরিশোধ করা হয় মোট ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এর মধ্যে সুদ বাবদ ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার ডলার এবং আসল দিতে হয়েছে ১৫১ কোটি ৬৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ফলে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় পরিশোধ ৬৪ কোটি ৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার বা ২৪.৯০ শতাংশ বেড়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন হারও ঝিমুনিতে
গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বাস্তবায়ন হার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ)। এই সময়ে বাস্তবায়ন হার হলো মাত্র ৩৬.৬৫ শতাংশ। এমনকি প্রকল্প সহায়তা খরচের হারও গত ৫ বছরের মধ্যে নিম্নে। উল্লেখিত সময়ে প্রকল্প সহায়তার অর্থ ব্যয় হয়েছে ৪০.০১ শতাংশ।
যা বললেন ড. জাহিদ হোসেন
সবদিকে কেন খরা জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, এটি একটি অস্বাভাবিক বছর এবং অস্বাভাবিক ৯ মাস। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুই ধরনের দুর্যোগ অর্থনীতিতে ছিল। এখানে প্রকল্প সহায়তা তখনই আসে যখন প্রকল্প বাস্তবায়ন এগিয়ে যাবে। যখন খরচ হয় তখন টাকাটা দেয়। আপনি যদি খরচ করতে না পারেন, বাস্তবায়ন যদি থেমে থাকে, তাহলে তো অর্থ ছাড় হবে না।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরেও বাস্তবায়ন যারা করে সেই প্রশাসনকে সক্রিয় করতে সময় লেগেছে তাদের কাজে ফেরাতে। এখনো আমি বলবো যে, পরিবর্তনের আগে তারা যেভাবে বা যে গতিতে কাজ করতো সে পর্যায়ে কাজের গতি পুরোপুরি ফিরে আসেনি। বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন তো চলছেই। ওই একই কারণে বিদেশীদের সহায়তার প্রতিশ্রুতি কমেছে।
ড. জাহিদ বলেন, প্রতিশ্রুতি পেতে হলে তো প্রকল্প তৈরি করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে যেতে হবে। যেখানে আপনাকে তারা বাজেট সহায়তা দেবে। প্রকল্প সহায়তার বাহিরে যে সহায়তা দেয়। তিনি বলেন, নতুন সরকার আসার পরে নতুনভাবে সব কিছু করতে গিয়ে তো তারা বলেছেন যে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অনেক প্রকল্প আছে যেগুলো বাজে প্রকল্প। যাচ্ছে তাই প্রকল্প। কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই এসব প্রকল্পকে ঢুকানো হয়েছে। তারা বলেছেন, এ ধরনের প্রকল্প আমরা নেবো না। গত সরকারের আমলে আগে যেমন প্রতি সপ্তাহে একনেক সভায় গড়ে ১০টা করে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হতো, এখন অনুমোদনের সংখ্যা কিভাবে কমেছে। তিনি বলেন, সরকার এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। পচা প্রকল্পগুলোকে পরিষ্কার করতে হবে। আর প্রকল্প পাসের ব্যাপারে কোনো চাপ নেই। রাজনৈতিক সরকারের আমলে যেটা ছিল। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় একটা নির্দেশই ছিল প্রতি সপ্তাহেই আমার কিছু প্রকল্প অনুমোদন দিতে হবে। যেটা এখন নেই। তিনি বলেন, প্রকল্প তৈরি করতে না পারলে তো আপনাকে তারা প্রতিশ্রুতি দেবে না। তবে এখন আমরা অর্থ উপদেষ্টার মধ্যেও একটা তুষ্টির ভাব দেখতে পাচ্ছি। আমাদের সহায়তা লাগবে না। ওমুককে লাগবে না। ওমুকের সহায়তা লাগবে না। এমনকি গভর্নরের মধ্যেও একটা গোয়ার্তুমি চলে এসেছে।