Hot

সিন্ডিকেটই খাচ্ছে শ্রমবাজার

জনশক্তি রপ্তানির নিরিখে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। গত বছর সেখানে সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক গিয়েছিল, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১৪ হাজারের বেশি শ্রমিক গেছে। মালয়েশিয়া বাংলাদেশের রমরমা শ্রমবাজার হলেও দুর্নীতির কারণে তা বন্ধের পথে।

এর জন্য দায়ী কে? এমন প্রশ্নে সংশ্লিষ্টরা দুই দেশেই গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। সরকারিভাবে মালয়েশিয়া যেতে একজন শ্রমিকের খরচ হওয়ার কথা ৭৮ হাজার টাকা। কিন্তু যেতে হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে। তারপরও প্রবাসী হয়ে মানবেতর জীবন পার করতে হচ্ছে। কাজ দূরের কথা, থাকা-খাওয়ার জায়গাও পায় না শ্রমিকরা।

অনেক শ্রমিক মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে বিভিন্ন এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছে। আকুতি জানাচ্ছে বাড়িতে ফেরার। এমন পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়া সরকার কড়া ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। তারা আগামী ১ জুন থেকে কোনো বিদেশি শ্রমিক নেবে না বলে জানিয়েছে। ২০১৮ সালের পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় যাওয়া আবার বন্ধ হচ্ছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে দুটি চক্র শ্রমিকদের পকেট কেটে কোটিপতি হয়েছে। কলিং ভিসায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত শ্রমিক পাঠানো হয়েছে। মালয়েশিয়ায় গিয়ে অধিকাংশ শ্রমিক বেকার ও দুর্বিষহ জীবন পার করছে। ২০১৮ সালে যে চক্রটির কারণে মালয়েশিয়া শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করেছিল, সে চক্রের কারণে এবারও এ শ্রমবাজার বন্ধ হতে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘দুই দেশেরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, ফলে শ্রমিকরা প্রতারণা ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। বাজারটি টেকাতে হলে এ সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

মালয়েশিয়া সরকার ভিনদেশি কর্মীদের কাজ করার জন্য যে ভিসা দিয়ে থাকে তাকে কলিং ভিসা বলে। এ ভিসার আওতায় একজন কর্মী নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় থাকতে পারে। কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে এখন অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক বেকার। দেশের অনেক এজেন্সি এজন্য দায়ী। তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোক পাঠিয়ে সমস্যা বাধায়।

দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করেছিল।

তখন ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির গড়ে তোলা চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হন লাখো শ্রমিক। চাকরির নিশ্চয়তা, আবাসন ও খাওয়ার ব্যবস্থার কথা বলে তারা হাতিয়ে নেয় কয়েক কোটি টাকা। বন্ধ হওয়া শ্রমবাজার আবার চালু করতে সময় লেগেছিল তিন বছর। ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নতুন সমঝোতা চুক্তির আওতায় ফের চালু হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০২২ সালের আগস্টে ফের বাংলাদেশি কর্মীদের সেখানে যাওয়া শুরু হয়।

নতুন সমঝোতার পর আগের মতোই পুরনো চক্রের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় কর্মী নিয়োগ। ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট ভেঙে দায়িত্ব দেওয়া হয় ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সিকে। পরে শ্রমিক পাঠানোর অনুমতি পায় ১০০ এজেন্সি। তবু অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। নতুন সমঝোতার পর সে দেশে গিয়ে লাখো বাংলাদেশি কর্মী প্রতারিত হয়েছেন। মাসের পর মাস কাজ না পেয়ে এখনো বন্দিজীবন পার করছেন অনেকে। তারা দেশে ফিরতে আকুল।

এমনি এক যুবক মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের তুহিন আলী। তিনি দেশে থাকতে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে সংসার চালাতেন। স্থানীয় দালাল রাজু তাকে ভালো কাজ ও বেতনের কথা বলে মালয়েশিয়ায় পাঠান। বিনিময়ে তার কাছ থেকে নিয়েছেন ৫ লাখ টাকা। এনজিওর ঋণ ও বাড়ির গবাদিপশু বিক্রি করে এ টাকা ম্যানেজ করেন তুহিন। মালয়েশিয়ায় গিয়ে এখন তিনি বন্দিজীবন পার করছেন। তিনি মাকে ফোন করে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় এলে কয়েকজন লোক আমাকে নিয়ে যায় রাজধানী কুয়ালালামপুরের “সালাক সালাতান” ক্যাম্পে। সেখানে আমার মতো মেহেরপুর সদর, গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের তিনশর বেশি যুবক এখন বন্দিজীবন পার করছে।’

মেহেরপুরের ভুক্তভোগী একাধিক পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। তারা বলেন,

 ঢাকার মুসা এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে তারা তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। ইঞ্জিনিয়ার মুসা কলিমের ‘নাভিরা ও মুসাকলি’ এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে তারা ভালো কাজের আশ্বাসে তারা মালয়েশিয়ায় যান। কিন্তু তিন-ছয় মাসেও দালাল চক্রের সদস্যরা তাদের কাজ দিতে পারেনি।

শ্রমিকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়া সরকার নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কোনো বিদেশি কর্মী নিয়োগের আবেদন অনুমোদন করা হবে না। যারা অনুমোদন পেয়েছে তাদের কর্মীদের ৩১ মার্চের মধ্যে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। যারা ভিসা নিয়েছে বা নেবে, তাদের মালয়েশিয়ায় প্রবেশের শেষ সময় আগামী ৩১ মে।

কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণার জন্য দুই দেশের চক্রই জড়িত বলেছেন

 ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। হাইকমিশনার বলেন, সমস্যার কারণ সিন্ডিকেট, যারা এখানে ও মালয়েশিয়ায় সক্রিয়।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় ২০২২ সালের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ১৬ হাজার ১২৫ জন শ্রমিক গিয়েছে। তাদের মধ্যে এখন বেকার, বেতনহীন ও কম বেতনে চাকরি করা কর্মী অন্তত এক লাখ।

বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস (বিসিএসএম) এ সমস্যার সমাধানে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশকে যৌথভাবে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

২০২২ সালের পর যেসব বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় গেছে তাদের একাংশের দুর্ভোগ গত কয়েক মাস ধরে উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে বিসিএসএম। তারা বলেছে, বাংলাদেশের সিন্ডিকেটভুক্ত কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ার এমন কোম্পানিতে কর্মী পাঠিয়েছে, যাদের কর্মী নিয়োগের সক্ষমতা নেই এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওই নামের কোনো কোম্পানিই নেই। হাজার হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে লাখ লাখ টাকা দিয়ে রেখেছে। তারা কলিং ভিসা নিয়ে ভিসা স্ট্যাম্পিং ও ই-ভিসার জন্য অপেক্ষমাণ। সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিসিএসএম।

মালয়েশিয়া দূতাবাসের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে শ্রমবাজার বন্ধের নেপথ্যে ছিল দুর্নীতি। এরপর মালয়েশিয়া সরকার সে বছরের ১ সেপ্টেম্বর কর্মী নিয়োগের ‘এসপিপিএ’ সিস্টেম বাতিল করে। এরপর নতুন অনলাইন সিস্টেম তৈরি করে যার নাম ‘এফডব্লিউসিএমএস’। এ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশের ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী নিয়োগের জন্য নিযুক্ত করে। মালয়েশিয়া সরকার ‘সিনারফ্লেক্স’ নামে একটি কোম্পানিকে নিয়োগের বিষয়টির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়। সিনারফ্লেক্সের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে বেস্টিনেট নামে একটি কোম্পানিকে ‘এফডব্লিউসিএমএস’ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়। এ কোম্পানিই বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়ার সব কাজ করে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) সভাপতি মো. আবুল বাশার বলেন, ‘সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ার সরকার তৈরি করেছে। আমরা আন্দোলন করেছিলাম। মালয়েশিয়ার সরকার তখন বলেছে, কর্মীদের চাকরি দেওয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। ফলে তাদেরই এ দায়িত্ব বহন করতে হবে।’

শ্রমিকদের প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা প্রথমত রিক্রুটিং এজেন্সির বিষয়। তাদের মাধ্যমেই শ্রমিকরা গেছে। এজেন্সি দায়িত্ব না নিলে আমরা তাদের তাগাদা দেব।’

সম্প্রতি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। কর্মী পাঠানোতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ধীরে ধীরে সব সমস্যার সমাধান হবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button