Bangladesh

সিন্ডিকেটের খপ্পরে কঠিন শিলা খনি

সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েছে দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি প্রকল্প। দেশে পাথরের জন্য হাহাকার থাকলেও এই খনির গোডাউনে স্তূপ হয়ে আছে ৮ লাখ টনের বেশি। গোডাউনসহ খনি এলাকার কোথাও পাথর রাখার জায়গা নেই। অথচ দেশে একের পর এক আমদানি হচ্ছে পাথরের চালান। চলে যাচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু নির্বিকার খনি কর্তৃপক্ষসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোবাংলা। জানা গেছে, পাথর বিক্রি না হওয়ায় গত এক বছরে ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকারও বেশি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পাথরের দাম নিয়ে মধ্যপাড়া গ্রানাইড মাইনিং কোম্পানি (এমজিএমসিএল), পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগের একটি অসাধু সিন্ডিকেট কাজ করছে। তাদের সমন্বয়হীনতা, অদূরদর্শিতা ও আমদানি নির্ভরতা নীতির কারণে পাথরের স্তূপ জমেছে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন পাথরের দাম কম তখন খনির পাথরের দাম বাড়িয়ে রাখে এই সিন্ডিকেট। এতে খনির পাথর বিক্রি হয় না। গত এক বছর ধরে চলছে এই অচলাবস্থা। আবার বিশ্ববাজারে দাম বেশি থাকলে দেশে কমানো হয়। এতে মুহূর্তে সিন্ডিকেট গোডাউন খালি করে পুরো পাথর কিনে নিয়ে যায়। এভাবে সিন্ডিকেটকে অবৈধ সহায়তা দিয়ে গত এক বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি অর্থ লোকসান দিয়েছে খনি কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে।

মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে পাথরের দাম কম। কস্ট প্রাইস, ট্যাক্স, ট্রান্সপোর্ট ও লাভসহ আন্তর্জাতিক বাজারে এতদিন প্রতি টন পাথরের দাম ৩ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু গত ১ বছর ধরে দেশীয় পাথরের দাম হচ্ছে টনপ্রতি ৩ হাজার ৮০০ টাকা। প্রতি টন দেশীয় পাথর ৭০০ টাকা বেশি হওয়ায় আমদানির দিকে বেশি ঝোকেন ক্রেতারা।

ওই কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে পাথরের দাম নির্ধারণের জন্য গত বছরের অক্টোবর থেকে কয়েক দফা পেট্রোবাংলার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। এই সুযোগে পুরো বাজার আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, এভাবে যদি খনির গোডাউনে পাথরের স্তূপ থাকে তাহলে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ পাথর রাখার জায়গা না থাকলে খনি বন্ধ করে রাখতে হয়। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে সম্প্রতি এমজিএমসিএলের পরিচালনা পর্ষদ পাথরের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে টনপ্রতি ৬০০ টাকা কমিয়ে ৩ হাজার ২০০ টাকা করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে পেট্রোবাংলার কাছে। কিন্তু এটি নিয়েও চলছে নানা কূটকৌশল।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দাম কমানোর এই প্রস্তাব জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, গত এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে পাথরের দাম কম। এতদিন দাম সমন্বয় করা হয়নি। তারা এমন সময়ে দাম কমিয়েছে, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে। ফলে দেশে দাম কমে যাবে আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়বে। এই মুহূর্তে দাম কমালে দেখা যাবে সিন্ডিকেট মুহূর্তে পুরো গোডাউন খালি করে দেবে। তাতে ফের বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বে খনি। এখন দাম সমন্বয়ের বিষয়টি যাচাই-বাছাই পর্যায়ে আছে। এর আগেও এভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি থাকলেও খনি কর্তৃপক্ষ দাম কমিয়ে পাথর বিক্রি করে কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক পরিকল্পনা আব্দুল মান্নান পাটওয়ারী খনির গোডাউনে পাথরের স্তূপ জমে থাকার তথ্য জানিয়ে বলেন, ইতোমধ্যে খনির পরিচালনা পর্ষদ পাথরের দাম কমিয়েছে। আশা করছি এবার পাথর বিক্রি হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে লক্ষ্য রাখছি। যখনই সেখানে দাম কমবে তাৎক্ষণিক আমরা সমন্ব^য় করব।

মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু দাউদ মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, মে-তে খনি থেকে উত্তোলন করা হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার টন পাথর। জুন ও জুলাইয়ে যথাক্রমে ১ লাখ ৩৯ হাজার ও ১ লাখ ৩৫ হাজার টন পাথর উত্তোলন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সবার সহযোগিতা থাকলে বর্তমান লক্ষ্যমাত্রা ৮৮ লাখ ৬০ হাজার টন পাথর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উত্তোলন করা সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমানে খনির উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে বেলারুশ ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়া কোম্পানি জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের (জিটিসি)। দায়িত্ব নেওয়ার পর জিটিসি খনির ভূগর্ভে অত্যাধুনিক ও বিশ্বমানের মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট বসিয়েছে। ইউরোপিয়ান সুদক্ষ প্রকৌশলী দল ও দক্ষ খনি শ্রমিক দিয়ে পাথর উত্তোলন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। জিটিসির হাত ধরে খনিটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো লাভের মুখ দেখে।

এভাবে একের পর এক পাথর উত্তোলনের রেকর্ড গড়ার পরও সিন্ডিকেটের নানা কারসাজিতে খনিটি বন্ধের উপক্রম হওয়ায় নেপথ্যে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই কারসাজির নেপথ্যে রয়েছে একটি চীনা কোম্পানিকে খনির উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ দেওয়ার চক্রান্ত। এর অংশ হিসাবে জিটিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন, পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগে একাধিক উড়ো চিঠি দিয়েছে সিন্ডিকেট। দুদক এসব চিঠির তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায়নি। পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগও একাধিকবার তদন্ত কমিটি গঠন করে জিটিসির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের সত্যতা পায়নি। সর্বশেষ কোনো কিছু করতে না পেরে সিন্ডিকেট এখন পাথরের দাম নিয়ে কারসাজি করে খনিকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা পাঁয়তারা করছে। কিন্তু জ্বালানি বিভাগের মনিটরিংয়ের কারণে এ কারসাজি ভেস্তে যাওয়ায় এখন খনির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের বিল আটকে দিয়েছে ওই পরিচালক। জানা গেছে, গত ৬ মাস ধরে কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না জিটিসি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন সহস্রাধিক দেশি-বিদেশি খনি শ্রমিক। তারা হুমকি দিয়েছেন বেতন-ভাতা না দিলে কাজ বন্ধ করে দেবেন। এমজিএমসিএল সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে পেট্রোবাংলা জিটিসির মোট বিলের ২৫ শতাংশ করে টাকা কর্তন করে রাখছে। এখানে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা রয়েছে। কিন্তু সিপিটিইউ ও আন্তর্জাতিক আইনুযায়ী পেট্রোবাংলার কোনো টাকা কর্তন করার সুযোগ নেই। সিপিটিইউ বলছে, এটা তাদের সম্পাদিত কাজের বিল। তাদের চুক্তির মেয়াদ আরও ৫ বছর আছে। এছাড়া চুক্তির বিপরীতে বড় অঙ্কের টাকা পারফরম্যান্স গ্যারান্টি দেওয়া আছে। পেট্রোবাংলার আইনজীবীও একই মতামত দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও সিন্ডিকেট কোনো কথা শুনছেন না। সিপিটিইউর এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, চুক্তি অনুযায়ী কোনো টাকা কর্তন করলে সেটি অবৈধ হবে। এতে খনির শ্রমিক অসন্তোষ ও খনি বন্ধ হয়ে গেলে পুরো দায় পেট্রোবাংলার ঘাড়ে বর্তাবে।

এ প্রসঙ্গে এমজিএমসিএল পরিচালনা পর্ষদের এক সদস্য বলেন, বিষয়টি তিনি দেখবেন। প্রয়োজনে এমজিএমসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে খনি সচল রাখার জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলবেন। খনির উৎপাদনের সঙ্গে বিদেশি কোম্পানি জড়িত। এই কোম্পানিতে দেশি ও বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞরাও কাজ করছেন। তাদের বেতন-ভাতা কোনোভাবেই বন্ধ রাখা যাবে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button