Bangladesh

সিন্ডিকেট ভাঙতে ভুল কৌশল!

উৎপাদনকারী প্রধান ৯টি জেলায় এ মুহূর্তে যে পেঁয়াজের মজুত রয়েছে, তা দিয়ে অনায়াসে আরও ১৫ দিন ভোক্তার চাহিদা মেটানো যাবে। এ সময়ের পর দেশি পেঁয়াজ উঠতে শুরু করবে। এছাড়া আমদানির জন্য আগেই এলসি খোলা বেশকিছু পেঁয়াজ ভারত থেকে দেশে ঢুকবে। সব মিলিয়ে এখনো পেঁয়াজের যে মজুত আছে, তাতে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণায় বাজারে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়ার কথা না। অথচ সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এক রাতেই পেঁয়াজের দাম এক লাফে বেড়েছে দ্বিগুণ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যা রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

শুধু পেঁয়াজই নয়, চিনি, সোয়াবিন তেল ও মসলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের বাজার সিন্ডিকেট সাধারণ ভোক্তাদের জিম্মি করে রেখেছে। এতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এ চক্রের অপতৎপরতা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে।

বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, তিন টার্মে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের মেয়াদপূর্তি হতে চললেও দীর্ঘ এ সময়ে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে সরকার বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। বরং দুর্নীতিবাজ এ চক্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততার বিস্তর অভিযোগ মিলেছে মন্ত্রী-এমপিদের। সিন্ডিকেট ভাঙতে গেলে উল্টো বেকায়দায় পড়তে হতে পারে বলে দায় এড়িয়েছে সরকারের দায়িত্বশীলরা।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ভুল কৌশলের কারণেই সরকার মূলত বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙতে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া অধিকাংশ কৌশলী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে সফল না হওয়ায় এই চক্র দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে।

বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, মূল সংকটের সমাধান না করে এলোমেলোভাবে তদারকি বাড়ানোর কারণে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং কোনো কোনো পণ্যের বাজার উল্টো তেঁতে উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ভাঙতে অবৈধ মজুতদারদের কঠোর সাজার আওতায় আনা এবং তদারকি কার্যক্রম সারা বছর জোরদার রাখা জরুরি। অথচ এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বরাবরই ভুল পথে হেঁটেছে।

তাদের এসব অভিযোগ যে অমূলক নয়, সরেজমিন অনুসন্ধানে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, শুধু নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হলেই নানা পদক্ষেপ গ্রহণের হাঁকডাক শুরু হয়। তবে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব কার্যক্রম শুরুর আগেই বেশিরভাগ সময় মুখ থুবড়ে পড়ে। বেপরোয়া সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের প্রভাবশালীদের আঁতাত থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন কৌশল বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। বরং এসব কৌশল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। যা তারা নিজেরাই অপকটে স্বীকার করেন। এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাজার অস্থিতিশীল হলেও এর নেপথ্যে সরকারের তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্তের অভাব ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাসহ আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। তাই শুধু বাজার তদারকি করে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা যাবে না। বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠান আছে যেমন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বা প্রতিযোগিতা কমিশন- এসব প্রতিষ্ঠানের খবরদারিতে দুর্বলতা রয়েছে। আর এ কারণেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যাচ্ছে না। তারা মনে করেন, এসব প্রতিষ্ঠানের উচিত বাজার ব্যবস্থাকে একটা নজরদারির মধ্যে নিয়ে এসে মূল্যস্ফীতি অযৌক্তিকভাবে বাড়ছে কি না সে বিষয়ে সার্বক্ষণিক সতর্ক নজর রাখা।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। তার মতে, উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর- এই দুই পর্যায়ে যারা মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে বাজারটা একচেটিয়াভাবে চলে গেছে। তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এ কারণে যে মূল্যটা সেটা বাজারের প্রতিযোগিতার সক্ষমতার নিরিখে হচ্ছে না। তিনি বলেন, এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই বাজারের মূল্য নির্ধারণ করছে এবং অনেক সময় সরবরাহকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে সামনে এনেছেন অর্থনীতিবিদ ডক্টর সেলিম রায়হানও। তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ীরা একটা সাময়িক সরবরাহ সংকট তৈরি করে কোনো কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ফেলে। যেটার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। চিনি বা ভোজ্যতেলের মতো খাতে সরবরাহকারীর সংখ্যাও হাতেগোনা, মাত্র তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে বাজারকে প্রভাবিত করার প্রবণতা আছে বলে মনে করেন তিনি। বাজারে অ্যান্টি-কমপিটিটিভ প্র্যাক্টিসের (প্রতিযোগিতাহীন অবস্থা) নিদর্শন পাওয়া যায়, অথচ এগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ দেখা যায় না- যোগ করেন সেলিম রায়হান।

দেশের বাজারে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে বড় ধরনের দুর্বলতা থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, বাজারে চাহিদা কত, সরবরাহ কত, উৎপাদন কত, আমদানি কতটুকু করতে হবে এবং সেটা কোন সময়ে করতে হবে, সেই আমদানিটা উন্মুক্তভাবে হচ্ছে কি না- এসব তথ্যের ভিত্তিতে বেশিরভাগ সময়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। ফলে যথেচ্ছভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

এদিকে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ- ক্যাব মনে করে সিন্ডিকেট ভেঙে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ট গাফিলতি আছে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পেঁয়াজের মূল্য দ্বিগুণ হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করেছে, সঙ্গে সঙ্গে এটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে, যেখানে পেঁয়াজ আগে থেকেই আছে, আমরা মনে করি এটা সুশাসনের ঘাটতি।

তিনি অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছে, সরকারের কোনো বিধিবিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। আর সরকারের বিভিন্ন বিভাগ যারা যুক্ত তাদের নীরবতাও প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা বারবার বলেছি সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটা বার্ষিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। কখন আমদানি করবে আর কখন দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা পূরণ হবে, এরকম কোনো উদ্যোগ দেখিনি। কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকা সংযুক্ত অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এদিকে সত্যিকার অর্থে সরকার বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, সরকার চাইলে সবকিছুই করতে পারে, যদি সদিচ্ছা থাকে। কারা এই বাজার কারসাজি করছে, সরকার যে জানে না, এমন নয়। এখন তারা সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কি না, সেটিই প্রশ্ন। সেটি করতে গেলে আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পণ্য সরবরাহ, পণ্যের দাম ইত্যাদি একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। এখন একটি পণ্যের দাম বাড়ল, তখন হইচই পড়ে গেল আর সেই পণ্যের জন্য দু-একটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এরপর আরেকটা পণ্যের দাম বাড়ে, এরপর আরেকটা। এভাবে চলতেই থাকে। এটি এ দেশে নতুন কিছু নয়। এখন সামগ্রিক একটা ব্যবস্থাপনা বা কাঠামো থাকলে সিন্ডিকেটের সুযোগ নেওয়া কঠিন হতো। সেই ব্যবস্থাপনা থাকলে, প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুত পণ্য আমদানি করা সম্ভব হয়। কোন দেশের পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, কী ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়, কোন দেশ থেকে পণ্য আনতে কেমন সময় লাগবে- এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এখন পণ্যের দাম বাড়ে, আমদানির সিদ্ধান্ত ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে নিতেই ভোক্তার পকেট খালি হয়ে যায়।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পণ্যের দাম যখন অনেক বেড়ে যায়, তখন শুল্ক কমিয়েও পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। তবে সেটার জন্য শক্ত নজরদারির প্রয়োজন হয়, যাতে সুবিধাটা ভোক্তারা পেতে পারে। অথচ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের এ ধরনের তৎপরতা নেই বললেই চলে। এদিকে বাজার কারসাজি ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোও জরুরি বলে মনে করেন তারা।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, প্রতিযোগিতা কমিশন বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যার কথা অনেকে জানে না। তাদের দক্ষতা ও মানবসম্পদ বাড়াতে হবে। আইনিভাবে এটিকে শক্তিশালী করতে হবে। তারা বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে, কিন্তু সেগুলোর নিষ্পত্তি হয় না। সিন্ডিকেট করার কারণে শাস্তির বিধান থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয় না। শুধু জরিমানা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলও সেকেলে বলে মন্তব্য করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d