International

সিন্ধু পানিচুক্তি নিয়ে আবারো ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাতের আশঙ্কা

যুদ্ধের সরাসরি লড়াই থেমে থাকলেও উভয় দেশ কূটনৈতিক প্রচারণায় নেমেছে বিশ্ববাসীকে নিজেদের অবস্থান বোঝাতে।

সাত দশক আগে দক্ষিণ এশিয়ার খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টো পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে ছোটগল্প লিখেছিলেন। গল্পটি আবর্তিত হয়েছিল একটি গুজবকে ঘিরে- ভারত পাকিস্তানের জন্য সেচনির্ভর নদীগুলোর পানি বন্ধ করে দেবে।

১৯৫১ সালের ‘ইয়াজিদ‘ গল্পে এক চরিত্র বলে ওঠে, ‘…কে নদী বন্ধ করতে পারে; এটা কোনো নালা নয়, নদী।‘

৭৪ বছর পর সেই আশঙ্কা বাস্তব পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছেঅ যার প্রভাব পড়ছে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দুই প্রতিবেশী দেশের ওপর, যারা উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর।

২০২৫ সালের এপ্রিলে ভারত-শাসিত কাশ্মিরে এক হামলায় বন্দুকধারীরা ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক হত্যা করে। তাদের বেশিরভাগই পর্যটক ছিলেন। নয়াদিল্লি এ হামলার জন্য পাকিস্তান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর দোষ চাপায়।

এর জবাবে ভারত জানায়, তারা সিন্ধু পানিচুক্তি (আইডব্লিউটি) থেকে সরে আসছে। ছয় দশকের পুরনো এই চুক্তি সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানির বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে, যা ২৭ কোটির বেশি মানুষের জীবনের ওপর নির্ভরশীল। তাদের বেশিরভাগই পাকিস্তানে বাস করেন।

ভারতের ঘোষণার পরদিনই পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি) একতরফা পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে এবং হুঁশিয়ারি দেয়, ‘পাকিস্তানের পানির প্রবাহ ব্যাহত হলে, তা হবে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।‘ এর পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চার দিনব্যাপী তীব্র সঙ্ঘর্ষ ঘটে। ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা পাল্টাপাল্টি চলে। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয়।

যুদ্ধের সরাসরি লড়াই থেমে থাকলেও উভয় দেশ কূটনৈতিক প্রচারণায় নেমেছে বিশ্ববাসীকে নিজেদের অবস্থান বোঝাতে।

ভারত সিন্ধু চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। ২১ জুন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ -প্রধানমন্ত্রীর পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী- ঘোষণা করেন, চুক্তিটি স্থায়ীভাবে স্থগিত থাকবে।

তিনি ভারতের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল দুই দেশের শান্তি ও অগ্রগতি। কিন্তু একবার তা ভঙ্গ হলে রক্ষার আর কিছু থাকে না।’

নিম্নপ্রবাহবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্য পানির প্রবাহ ব্যাহত হওয়া অস্তিত্বগত হুমকি। কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও লাখ লাখ মানুষের জীবিকা এই পানির ওপর নির্ভরশীল।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, নদীর পানি পুরোপুরি বন্ধ করা ভারতের পক্ষে এখন সম্ভব না হলেও আংশিক ব্যাঘাতও পাকিস্তানে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে শীতকালে। পাকিস্তানের বর্তমান জলাধার কাঠামো ভারত যদি পানির প্রবাহ রোধ করে, তা সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।

একটি অঞ্চল, একটি নদী

বিশ্বের ১২তম দীর্ঘতম নদী সিন্ধু উৎপন্ন হয়েছে তিব্বতের কৈলাস পর্বত থেকে ৫,৪৯০ মিটার (১৮,০০০ ফুট) উচ্চতায়। এটি কাশ্মির অঞ্চল পেরিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে প্রায় ৩,০০০ কিলোমিটার (১,৮৬৪ মাইল) দক্ষিণে আরব সাগরে গিয়ে পড়ে। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে সিন্ধু নদীর সাথে যুক্ত হয় এর পশ্চিম উপনদী সোয়াত ও কাবুল নদী। পাঞ্জাবের উর্বর সমভূমিতে প্রবেশের পর সিন্ধুর সাথে যুক্ত হয় পাঁচটি পূর্ব উপনদী- ঝিলাম, চেনাব, রাভি, বিয়াস ও শতদ্রু। এই নদীগুলি ভারত অধিকৃত কাশ্মির ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে।

উচ্চপ্রবাহবর্তী দেশ ভারত এবং নিম্নপ্রবাহবর্তী দেশ পাকিস্তানের মধ্যে এই ভৌগোলিক বাস্তবতা দীর্ঘদিনের অবিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বজুড়ে পানিসঙ্কট

পানিকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব কেবল ভারত-পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ নয়। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ নিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। সম্প্রতি নীল নদে বাঁধ নির্মাণ করা ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে মিসর ও সুদানের ক্ষোভ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াতেও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী নিয়ে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিনের মতবিরোধ রয়েছে।

দেশভাগের দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার

অধিকাংশ ভারত-পাকিস্তান বিরোধের মতো, পানিসম্পর্কিত উত্তেজনার শিকড়ও নিহিত রয়েছে ১৯৪৭ সালের আগস্টে উপমহাদেশের বিভাজনের সময়, যখন দুই দেশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চল, যেখান থেকে ঝিলাম নদীর উৎপত্তি এবং চেনাব নদীর প্রবাহ সঙ্ঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ব্রিটিশ আমলে গঠিত ঐক্যবদ্ধ পাঞ্জাবের সেচ ব্যবস্থার বিভাজন। খাল, নদী এবং হেডওয়ার্ক একে অপরের সাথে জড়িত ছিল, যা পানি বণ্টনকে জটিল করে তোলে।

১৯৪৮ সালের মার্চ পর্যন্ত একটি স্বল্পস্থায়ী চুক্তি কার্যকর ছিল। কিন্তু এরপর ভারত দু’টি খালের মাধ্যমে পাকিস্তানে জলপ্রবাহ স্থগিত করে দেয়। এর ফলে পাকিস্তানি পাঞ্জাবের প্রায় আট শতাংশ চাষযোগ্য জমি পাঁচ সপ্তাহের জন্য পানিবিহীন হয়ে পড়ে। এই প্রাথমিক সঙ্কট মান্টোর ‘ইয়াজিদ’ গল্পকে অনুপ্রাণিত করে এবং সিন্ধু পানি চুক্তির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতা ও অর্থায়নে নয় বছরের আলোচনার পর ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।

কিংস কলেজ লন্ডনের ভূগোল বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মাজেদ আখতার আল জাজিরাকে বলেন, এই চুক্তি ছিল রাজনৈতিক বিভাজনের পর ‘পানিবাহী বিভাজনের’ প্রতিফলন। ব্রিটিশ আমলে পাঞ্জাবের একটি সমন্বিত সেচ ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিপুল বিনিয়োগ হয়েছিল, যা ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হওয়ায় জটিলতা তৈরি করে।

তিনি আরো বলেন, পানিবণ্টনের এই প্রশ্ন কাশ্মির ইস্যুর সাথেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই কাশ্মিরের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে; চীনও এই অঞ্চলের দু’টি অংশ পরিচালনা করছে। তবে ভারত পুরো কাশ্মির তার বলে দাবি করে। আর পাকিস্তান চীনের নিয়ন্ত্রিত অংশ বাদে বাকি অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করে।

আখতারের ভাষায়, ‘কাশ্মিরের আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ মানে সিন্ধু নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ, যা কৃষিনির্ভর ভারত ও পাকিস্তানের উভয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

সর্বশেষ মে মাসের সঙ্ঘাতের আগেও ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মির নিয়ে চারটি যুদ্ধের মধ্যে তিনটি লড়েছে।

নদীবণ্টনভিত্তিক চুক্তি

৮৫ পৃষ্ঠার এই চুক্তির কাঠামো ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পানিচুক্তিতে মোট প্রবাহের ভিত্তিতে পানি ভাগ হয়। কিন্তু আইডব্লিউটি-তে নদীগুলোকে ভাগ করে দেয়া হয়।

তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদী রবি, শতদ্রু এবং বিয়াস সম্পূর্ণভাবে ভারতের জন্য বরাদ্দ করা হয়। আর তিনটি পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব পাকিস্তানের একক ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত হয়।

তবে ভারতকে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোতে ‘রান-অব-দ্য-রিভার’ প্রকল্পের আওতায় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। শর্ত থাকে যে এ ধরনের প্রকল্প পাকিস্তানে অবিচ্ছিন্ন পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করবে।

চুক্তিতে একটি ত্রি-স্তরীয় বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাও রাখা হয়। প্রথমে, যেকোনো প্রযুক্তিগত বিরোধ স্থায়ী সিন্ধু কমিশনের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা হয়। এই কমিশনে দুই দেশের একজন করে কমিশনার থাকেন এবং এটি চুক্তির অধীনেই গঠিত।

যদি কমিশনে সমাধান না হয়, তাহলে বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের অধীনে একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয়। তা সত্ত্বেও বিরোধ মীমাংসা না হলে হেগ-ভিত্তিক স্থায়ী সালিশি আদালতে (পিসিএ) বিষয়টি তোলা হয়। পিসিএ কোনো জাতিসঙ্ঘ সংস্থা নয়; এটি একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা, যেখানে দেশগুলো পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যায়।

চুক্তিটি ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে কার্যকর থাকলেও এই আনুষ্ঠানিক বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া মাত্র তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে। সবগুলোই পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীতে ভারতীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ঘিরে- বাগলিহার, কিশেঙ্গঙ্গা ও র‍্যাটেল।

২০০৭ সালে ভারত চেনাব নদীর ওপর নির্মিত বাগলিহার বাঁধসংক্রান্ত বিরোধে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের রায়ে বিজয়ী হয় এবং পরের বছর প্রকল্পটি চালু হয়।

ঝিলাম নদীর ওপর নির্মিত কিশেঙ্গঙ্গা প্রকল্প নিয়েও পাকিস্তান আপত্তি তোলে। কারণ এতে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরে পানিপ্রবাহ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল। বিষয়টি পিসিএতে গেলে ২০১৩ সালে আদালত রায় দেয় যে ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পানি ব্যবহার করতে পারবে। তবে পাকিস্তানে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত রাখতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ২০১৮ সালে প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন। চেনাব নদীর ওপর নির্মিত র‍্যাটেল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বর্তমানে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সর্বশেষ উত্তেজনার উৎস।

পাকিস্তান এই বিরোধ পিসিএতে নিতে চাইলেও ভারত বলছে, আইডব্লিউটি অনুযায়ী আগে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। তবে ভারত এখন আর চুক্তির বিধান মানছে না। ফলে সালিশি প্রক্রিয়াও অনিশ্চয়তায় পড়েছে, যখন প্রকল্পের নির্মাণ চলছে।

‘রক্ত ও পানি’

আইডব্লিউটি ৬৫ বছরের ইতিহাসে নানা সঙ্কট ও সঙ্ঘাতের মুখেও টিকে রয়েছে। যুদ্ধ, ভারত-শাসিত কাশ্মিরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, বারবার সামরিক সঙ্ঘর্ষ, ভারতে বড় হামলা (যার দায় নয়াদিল্লি পাকিস্তান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ওপর দেয়), এমনকি উভয় দেশের পারমাণবিক পরীক্ষাও এই চুক্তিকে টলাতে পারেনি।

২০২৫ সালের এপ্রিলে পাহেলগাম হামলাকে একটি ভঙ্গুর মুহূর্ত হিসেবে দেখা হয়। তবে চুক্তির ভঙ্গুরতার লক্ষণ তার বহু আগেই প্রকাশ পেয়েছিল।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-শাসিত কাশ্মিরের উরি শহরের সেনাঘাঁটিতে হামলায় অন্তত ১৮ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ-ই-মুহম্মদকে দায়ী করে।

পাকিস্তান সরকারি সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলেও ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং পাকিস্তানকে ‘উগ্রবাদী রাষ্ট্র’ আখ্যা দেন, যা ‘উগ্রবাদী ও তাদের গোষ্ঠীগুলোকে’ সমর্থন দেয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেন, ‘রক্ত ও পানি একসাথে প্রবাহিত হতে পারে না।’ পাকিস্তানে পানিপ্রবাহ বন্ধের দাবিতে ভারতের ভেতরে তখন চাপ বাড়ছিল।

নয় বছর পর ভারত চুক্তি থেকে সরে গেলে সাবেক পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি মোদির বক্তব্যের চেয়েও আরো তীব্র সতর্কবার্তা দেন।

তিনি এপ্রিল মাসে সিন্ধু প্রদেশে এক সমাবেশে বলেন, ‘সিন্ধু আমাদের এবং আমাদেরই থাকবে। হয় এই নদী দিয়ে আমাদের পানি প্রবাহিত হবে, না হয় তাদের রক্ত।’

প্রতীকী নাকি বাস্তব?

অনেক পানি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আইডব্লিউটি স্থগিত করায় পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক কোনো বড় ক্ষতি হবে না। এটি বরং প্রতীকী অর্থেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলামাবাদভিত্তিক পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ নাসির মেমন এটিকে ‘রাজনৈতিক কৌশল’ বলে অভিহিত করেন, যার উদ্দেশ্য পানিপ্রবাহ বদলানো নয়, বরং পাকিস্তানে উদ্বেগ তৈরি করা।

প্রথমত, আন্তর্জাতিক আইনের একটি কাঠামো আছে, যেটিকে পাকিস্তান নিজেদের পক্ষে বলে মনে করে। মেমন আল জাজিরাকে বলেন, ‘মোদি দেখাতে চাইছেন যেন তিনি পাকিস্তানের পানি অবিলম্বে বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু আইনি দিক থেকে তিনি একতরফাভাবে আইডব্লিউটি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।’

ভারত চুক্তি স্থগিতের তিন সপ্তাহ পর বিশ্বব্যাংকের ভারতীয়-মার্কিন সভাপতি অজয় বঙ্গও বলেন যে আইডব্লিউটি এমন কোনো বিধান দেয় না, যাতে একতরফাভাবে চুক্তি স্থগিত করা যায়।

তিনি মে মাসে নয়াদিল্লি সফরের সময় বলেন, ‘চুক্তি স্থগিত করার কোনো ব্যবস্থা এতে নেই। এটি হয় বাতিল করতে হবে, নয়তো নতুন চুক্তির মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করতে হবে, যার জন্য দুই পক্ষের সম্মতি জরুরি।’

ভূগোল ও অবকাঠামোও ভারতের সক্ষমতাকে সীমিত করে। লন্ডনের কিংস কলেজের সমালোচনামূলক ভূগোলের অধ্যাপক দানিশ মুস্তাফা বলেন, এসব কারণেই পাকিস্তান এই ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘ভারতে পানি নিয়ন্ত্রণের প্রতি একধরনের উগ্র আসক্তি রয়েছে। আর পাকিস্তানে পানি নিয়ে এক ধরনের ভীতি, যা প্রায় হাস্যকর।’

সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর মধ্যে তিনটি শতদ্রু, বিয়াস এবং রাভি আইডব্লিউটি অনুযায়ী ভারতের একক ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত। বাকি তিনটি নদীর মধ্যে সিন্ধু ভারত-শাসিত কাশ্মির ও লাদাখ অতিক্রম করে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। কিন্তু মেমন বলেন, এই পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে খাল কাটা বা কৃষি প্রকল্প নির্মাণের তেমন সুযোগ নেই। এছাড়া সিন্ধু নদে এমন পর্যাপ্ত পানি নেই, যা দিয়ে ভারত বড় প্রকল্প নির্মাণ করতে পারে।’

অন্যদিকে, বাকি দুটি নদীর ওপর ভারতের পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প ঝিলামের উপর কিশেনগঙ্গা ও বাগলিহার বাঁধ এবং চেনাব নদীর ওপর নির্মাণাধীন র‍্যাটেল বাঁধ পাকিস্তানে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান আইডব্লিউটির আওতায় এর বিরোধিতা করেছে।

ইসলামাবাদ অভিযোগ করেছে, এসব প্রকল্প ভারতের হাতে পাকিস্তানের পানিপ্রবাহ কমাতে পারে এবং কিশেনগঙ্গা বাঁধ ঝিলামের গতি পরিবর্তন করতে পারে। নয়াদিল্লি অবশ্য এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তবে ভারতের পক্ষে ঝিলাম থেকেও পানি সরিয়ে নেয়া কঠিন। কারণ, নদীটি ভারত-শাসিত কাশ্মিরের বারামুল্লা ও জম্মুর মতো জনবহুল এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেখানে বাঁধ নির্মাণ মানে ওইসব জনপদের প্লাবনের ঝুঁকি।

চেনাবের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। মেমন বলেন, এই নদীর পানি বছরের বিভিন্ন সময়ে ‘বিঘ্নিত’ হতে পারে।

তিনি বলেন, চেনাব নদীতে বেশ কিছু স্থান রয়েছে যেখানে বাঁধ নির্মাণ সম্ভব। কিন্তু গ্রীষ্মকালে যখন পানি প্রবাহ সর্বোচ্চ, তখন তা ধরে রাখলে ভারতের নিজস্ব লোকজন প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে ভারতকে বাধ্য হয়েই পানি পাকিস্তান অভিমুখে প্রবাহিত করতে হবে।

নয়াদিল্লিভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পানি বিশেষজ্ঞ অনুত্তমা ব্যানার্জিও মনে করেন, ভারত নদীর প্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না। বরং নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে মাত্র।

তিনি বলেন, ‘চেনাব নদীর প্রবাহ বাঁধ ও সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তবে এর জন্য ভারতের বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন। ফলে পাকিস্তানের জন্য হুমকি তাৎক্ষণিক নয়।’

তবুও পাকিস্তান যত জলাধারই তৈরি করুক না কেন, ভারত যদি নদীগুলোর প্রবাহ পাকিস্তানের ভূখণ্ডে পৌঁছাতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, তবে তা শুধু স্বল্পমেয়াদে পানিপ্রবাহ ব্যাহত করতে পারবে; টিকে থাকার জন্য তা যথেষ্ট হবে না।

পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খুররম দস্তগীর খান বলেন, ভারত যদি মাঝারি থেকে দীর্ঘমেয়াদে পানি সরিয়ে নেয়া বা সংরক্ষণের সক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে পুরো অঞ্চলটিই যুদ্ধের মুখে পড়তে পারে।

ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের সিনিয়র নেতা খান আল জাজিরাকে বলেন, ‘ভারতের হুমকি একটি বাস্তব ও অস্তিত্বগত উদ্বেগ। সিন্ধু অববাহিকা একটি সভ্যতা। এই পানির প্রবাহই আমাদের পরিবেশ, সংস্কৃতি, শিল্প, কৃষি ও শিল্প খাতের টেকসই বিকাশ নিশ্চিত করেছে। অথচ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তার মন্ত্রীরা বারবার পাকিস্তানে প্রবাহিত প্রতিটি ফোঁটা পানি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন।‘

পাকিস্তানের আরেক সাবেক মন্ত্রী আসলামের মতে, এই হুমকি আরো উদ্বেগজনক। কারণ এটি প্রতিবেশীদের মধ্যকার আস্থার ভাঙনকে নির্দেশ করে।

ইসলামাবাদে আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আসলাম বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আমরা পাকিস্তানিরা মনে করি সীমান্তের ওপারে আর কোনো সদিচ্ছা অবশিষ্ট নেই।‘

তবে তিনি স্বীকার করেন, ভারতের দিক থেকেও এমনই অনুভূতি থাকতে পারে। ‘ভারতীয়রাও পাকিস্তান নিয়ে একইরকম ধারণা পোষণ করতে পারেন,’ বলেন তিনি।

নতুন সিন্ধু জলচুক্তি?

এই মুহূর্তে উভয় পক্ষই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। নয়াদিল্লি আইডব্লিউটি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের যেকোনো সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানি কর্মকর্তারা এটিকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে অভিহিত করে ভারতকে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন।

তবে বিশ্লেষক ও কিছু পাকিস্তানি রাজনীতিক এখনো কূটনীতি বা আন্তর্জাতিক আইনি হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার ওপর ভরসা রাখছেন।

আসলাম বলেন, ‘আমরা আশাবাদী যে ভারত একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে আচরণ করবে। শেষ পর্যন্ত যেভাবেই হোক, দুই প্রতিবেশীকেই বসে কথা বলতে হবে এবং একটি সমাধানে পৌঁছাতে হবে।‘

আল জাজিরা প্রতিরক্ষা, তথ্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলেও ভারত যদি ভবিষ্যতে পানি প্রবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হয় বা সে রকম সিদ্ধান্ত নেয়, সে পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

তবে একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পাকিস্তান ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক আইনি চ্যানেলে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরছে।

২০১৬ সাল থেকে পাকিস্তান হেগের স্থায়ী সালিশি আদালতে (পিসিএ) ঝিলাম ও চেনাব নদীর উপর ভারতের পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আসছে। গত সপ্তাহে পিসিএ রায় দেয় যে আইডব্লিউটি স্থগিত রাখার ভারতের সিদ্ধান্ত আদালতের বিচারিক কর্তৃত্বকে প্রভাবিত করে না।

তবে ভারত ধারাবাহিকভাবে পিসিএ-এর কর্তৃত্ব স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। ফলে নয়াদিল্লি আদৌ এই রায় মানবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সামনে মূলত দু’টি পথ খোলা- সামরিক প্রতিক্রিয়া কিংবা কূটনৈতিক সমাধান।

ওই সামরিক কর্মকর্তা আরো বলেন, সিন্ধু নদীর পানি ‘পাকিস্তানের ২৫ কোটির বেশি মানুষের জীবনরেখা’।

তিনি বলেন, ‘আমরা এটিকে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য মনে করি। ভারত যদি এমন কোনো পদক্ষেপ নেয় যা আমাদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে আমরা তার জবাব দেব। যুদ্ধ ঘোষণা আমাদের সেই প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার ও সক্ষমতা দেয়, যা আমরা আমাদের পছন্দসই সময় ও প্রেক্ষাপটে প্রদান করতে পারি।’

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক স্টিমসন সেন্টারের সাবেক ফেলো ব্যানার্জি বলেন, সাম্প্রতিক উত্তেজনার কারণে সংলাপের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হওয়ায় সামরিক প্রতিক্রিয়া এখন কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, পাকিস্তানের উচিত চুক্তিটিকে নতুনভাবে পর্যালোচনা করা এবং দেখা যে পরিবর্তিত রূপে চুক্তিটি তাদের কী ধরনের সুবিধা দিতে পারে। এটি একটি পুনর্গঠিত চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, যা উভয় পক্ষের জন্যই উপকারী হতে পারে।’

লন্ডনের কিংস কলেজের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাফা বলেন, আইডব্লিউটি থেকে ভারতের সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান নতুন করে আলোচনার টেবিলে বসতে পারে—যার মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলীয় নদীগুলোর কিছু পানির ওপর দাবি জানানো সম্ভব হতে পারে, যেগুলোর ওপর এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ভারতের।

আসলাম বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি আলোচনাই সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সেই সংলাপকে কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে। তিনি আরো বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত, আমি মনে করি পাকিস্তান সরকার তার অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট করেছে।’

তিনি বলেন, ‘যদি পাকিস্তানকে পানিবঞ্চিত করা হয়, তাহলে সামরিক সমাধানসহ সব ধরনের বিকল্পই আমাদের আলোচনার টেবিলে থাকবে।‘

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto