সিবিএ নেতার আলাদিনের চেরাগ
রাষ্ট্রায়ত্ত পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের এক কর্মচারী মাত্র ২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে এখন পৌনে ৪ কোটি টাকারও বেশি অর্থের মালিক হয়েছেন। যার মধ্যে অন্তত ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা অবৈধ বলে অভিযোগ উঠেছে। মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন নামে ওই কোটিপতি কর্মচারী প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগঠনের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক।
কী এমন আলাদিনের চেরাগ আছে তার হাতে তা খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মজীবন শুরুর পর ১৯৮৬ সালে মাসিক ২৩০ টাকা মূল বেতনে পিয়ন পদে তার চাকরি স্থায়ী হয়। ওই সময় মূল বেতনের সঙ্গে অন্যান্য সুবিধা মিলে সর্বসাকল্যে তার বেতনের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা হতে পারে বলে একটি সূত্র ধারণা দিয়েছে।
নাছির উদ্দিনের কর্মস্থল চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় গুপ্তখাল এলাকায় পদ্মা অয়েল কোম্পানির প্রধান স্থাপনায়। তিনি ক্ল্যারিক্যাল সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৯ বছর ধরে।
একই জেলার আনোয়ারা উপজেলার চাতুরী গ্রামের মৃত শেখ মোহাম্মদের ছেলে নাছির। বর্তমানে তিনি নগরীর হিল ভিউ এলাকায় শিশু একাডেমির পাশে ইক্যুইটি ভবনের দোতলায় বসবাস করেন।
২০১৩ সালে সিবিএর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর নাছিরের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে দ্রুত। এর পরের বছর ২০১৪ সালে পিয়ন থেকে ট্যাংক লরি হেলপার, কয়েক মাস পর চেকার এবং একই বছরে সুপারভাইজার পদে নিযুক্ত হন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, সিবিএ নেতা হওয়ার সুবাদে নাছির দ্রুত পদোন্নতি ও নানা সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে তার সম্পদও বাড়তে থাকে। এ ছাড়া সিবিএ কমিটির মেয়াদ ২ বছরের হলেও নানা কৌশলে তিনি ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের পদ আঁকড়ে থাকেন। ২০২০ সালে নির্বাচনে হেরে যান নাছির। পরের নির্বাচনে তিনি আবারও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে বর্তমানে ওই দায়িত্ব পালন করছেন। পদ্মা অয়েল কোম্পানির কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক নেতাদের যোগসাজশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ তেল চুরির অভিযোগ রয়েছে। নানা কৌশলে ধাপে ধাপে কোটি কোটি টাকার সরকারি তেল চুরির অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
সিবিএ নেতা নাছিরের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগ উঠলে তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয় (চট্টগ্রাম-১)। ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল দুদকের এক নোটিসের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১২ মে দুর্নীতি দমন কমিশনে নিজের সম্পদ বিবরণী জমা দেন তিনি। তাতে ২৭ লাখ ২৬ হাজার ৯০০ টাকার স্থাবর সম্পদ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দিয়ে ৫২ শতাংশ কৃষিজমি কেনা এবং পরে ২০০৬ সাল থেকে বিভিন্ন সময় ওই জমিতে ২৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের তথ্য দেন নাছির। কিন্তু চট্টগ্রামের গণপূর্ত কার্যালয়ের প্রকৌশলীদের হিসাবে ওই কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণে অন্তত ১ কোটি ৪২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের নামে তিনি ১ কোটি ১৭ লাখ ২৮ হাজার টাকার হিসাব গোপন করেছেন।
এর বাইরে তার আরও অনেক সম্পদ রয়েছে, যা আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগ তুলে সম্প্রতি নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১-এ মামলা করেছেন উপসহকারী পরিচালক সবুজ হোসেন। মামলায় প্রায় ২ কোটি ৫৬ লাখ ২৮ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং ২ কোটি ১১ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন, দীর্ঘদিন অনুসন্ধানের পর মামলাটি করা হয়েছে। একজন কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে মাসিক বেতনের বাইরেও কর্মচারীদের ওভারটাইমের মাধ্যমে অতিরিক্ত কাজ করে বাড়তি আয়ের সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ঘণ্টা হিসাব করে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পান কর্মচারীরা। এতে টাকার পরিমাণ একেক মাসে একেক রকম হয়। তবে সিবিএ নেতা নাছির ঠিকমতো কাজ না করেও প্রতি মাসে ওভারটাইমের নামে ৩০ হাজার টাকা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে নাছির বলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে মামলা করা হয়েছে সেগুলো ভিত্তিহীন। তার সব আয়ই বৈধ।
দুদকের মামলা ও অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে গেলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোন ধরেননি। বিরতি দিয়ে আবার ফোন দেওয়া হলে পরিচয় শুনে বলেন, ‘আমি এখন ব্যস্ত, পরে দেন। এরপর তিনি আর ফোন ধরেননি।’
নাছিরের বিষয়ে জানতে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাসুদুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। তবে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ ও প্রশাসন, প্রকল্প) সি এম জিয়াউল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। সংশ্লিষ্ট দপ্তর (দুদক) থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি পেলে কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নাছিরের নামে ১ কোটি ৭৯ লাখ ১৩ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ (জমি, ভবন ইত্যাদি) রয়েছে। জমি কিনে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ ছাড়াও তার নিজ উপজেলায় ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৫ বছরে ৪ দফায় প্রায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার জমি কেনেন বলে আনোয়ারা সাব-রেজিস্ট্রার নিশ্চিত করেছেন। তবে এই সম্পদের বিষয় গোপন রেখেছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি তার সম্পদ বিবরণীতে অস্থাবর সম্পদের (আসবাবপত্র, গবাদি পশু, মাছ ইত্যাদি) পরিমাণ দেখিয়েছেন ১ কোটি ২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। তবে বাস্তবে এই সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৭০ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।
দায়-দেনা বাদে পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ নাছিরের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এর বিপরীতে তার ১ কোটি ২০ লাখ ২৭ হাজার টাকা গ্রহণযোগ্য আয়ের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। অর্থাৎ নাছির উদ্দিনের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ অন্তত ২ কোটি ৫৬ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এ ছাড়া ২ কোটি ১১ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য তিনি গোপন রেখেছেন বলে দুদকের মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।