Bangladesh

সিমিনের ট্রান্সকম গ্রুপ মাফিয়া বললেন সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের

সিমিন রহমানের ট্রান্সকম গ্রুপকে মাফিয়া গ্রুপ হিসেবে অভিহিত করলেন কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। গত বুধবার তাঁর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি ট্রান্সকম গ্রুপের নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমানের ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃত্যুর বিচার দাবি করেছেন। আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি সিমিন রহমানের ভূমিকাকে রহস্যজনক বলে উল্লেখ করেছেন। জুলকারনাইন সায়েরের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। ‘কল্পনা করুন, একদিন সকালে আপনি একটি ফোনকল পেলেন যে, আপনার সুস্থ-সবল ভাই যে কি না একা বসবাস করত-তার কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কী করবেন? আপনি তারাতারি একটি এ্যাম্বুলেন্স কল করবেন। অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই যদি আপনার ভাইকে মৃত ঘোষণা করা হয়, আপনি পুলিশ রিপোর্ট করবেন। মৃত্যুর কারণ জানতে চাইবেন। আপনি অবশ্যই লাশের ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুটি স্বাভাবিক না হত্যাকান্ড, সেটি তদন্তের মাধ্যমে জানতে চাইবেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এর কোনকিছুই করা হয়নি ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত লতিফুর রহমানের বড় সন্তান আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায়।’

২০২৩ সালের ১৬ জুন সকালে গুলশানের ৩৬ নম্বর সড়কের একটি ভাড়া করা ফ্ল্যাটে আরশাদকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। আরশাদ সেখানে একা বাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরিস্থিতি সন্দেহজনক হতো না। মৃত্যুর মাত্র ১০ দিন আগে আরশাদ আইনি পরামর্শ নিয়েছিলেন তাঁর মা ও বোন সিমিনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতারণার মামলা করার জন্য। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে আরশাদ ও তাঁর মেঝ বোন শাযরেহ হককে বঞ্চিত করার কারণে তিনি এ আইনি পরামর্শ নেন। লতিফুর রহমানের একমাত্র ছেলে সন্তান হিসেবে আরশাদ ওয়ালিউর রহমান তাঁর বাবার কষ্টার্জিত সম্পত্তির একটি বড় অংশ পাওয়ার কথা। কিন্তু ২০০০ সালে বাবার মৃত্যুর পর তাঁর মা ও সিমিনের তৈরি করা একটি ভুয়া ‘সমঝোতা চুক্তিতে’ আরশাদকে সম্পত্তির সামান্য একটি অংশ দেওয়া হয়েছিল।

উল্লেখ্য, আরশাদের সঙ্গে তাঁর মা ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড় সিমিনের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই ভালো যাচ্ছিল না। সম্পত্তির জন্য ছেলে আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছে শুনে, তাঁর মা ২০২৩ সালের ১১ জুন আরশাদ ও শাযরেহ হকের বিরুদ্ধে একটি পাল্টা মামলা করেন। এর মাত্র পাঁচ দিন পরেই আরশাদকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ঘটনাস্থলে প্রথম কে গিয়েছিল? তাঁর মা ও বোন সিমিন। মেজো বোন শাযরেহ হক সবার আগে যেতে পারেননি। যদিও তাঁর সঙ্গেই আরশাদের সমস্ত জরুরি যোগাযোগ ছিল। মূলত তাঁর বাবার বাড়িতে দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে কাজ করা গৃহকর্মীদের মাধ্যমে তিনি ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ পান অনেক পরে। স্বামীসহ শাযরেহ হক আরশাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখতে পান ট্রান্সকম ও এসকেএফের স্টাফে পুরো বাসা পরিপূর্ণ। তাঁর মা, বোন ও ভাতিজা করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিচ্ছেন। শাযরেহ আরশাদকে তাঁর বিছানায় শোয়া অবস্থায় পেলেন। এ সময় আরশাদের দুই হাত প্রশারিত ছিল। তাঁর শরীর খুব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, যেটি কিছুক্ষণ আগে মৃত্যু হয়েছে বোঝায়। তাঁর আঙুল ও পায়ের নখে কালো দাগ দেখা যাচ্ছিল। এরপর থেকে ঘটনা আরও রহস্যজনক হতে শুরু করল। সিমিন তাঁদের সবচেয়ে ছোট বোন শাজনীন তাসনিম রহমানের কবর আরশাদের জন্যে খুঁড়ে ফেলতে বলছিলেন। যাঁকে ১৯৯৮ সালে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ আরশাদকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দাফন করতে হবে। শাজনীনের মৃত্যুর পর লতিফুর রহমান তাঁর পরিবারের জন্য বনানী গোরস্থানে আটটি কবর কিনেছিলেন। তাই শাজনীনের কবর খোঁড়ার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।

দাফনের জন্য একটি মৃত্যুসনদ প্রয়োজন হয়। তাই আরশাদের দেহ হাসপাতালে নেওয়া হয়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এসকেএফের কর্মীরা এই প্রক্রিয়াটি নিজেরাই পরিচালনা করার ব্যাপারে জোর দেন এবং পরিবারের সদস্যদের বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। হাসপাতালে এসকেএফের কর্মীরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছিলেন দ্রুত প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য। কারণ মৃতদেহটি জুমার নামাজের পরই দাফন করতে হবে।

সিমিনের ট্রান্সকম গ্রুপ মাফিয়া

হাসপাতালে ডিউটি ডাক্তার বলেছিলেন, যেহেতু আরশাদকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে তাই একটি পুলিশ রিপোর্ট প্রয়োজন। কিন্তু এসকেএফের কর্মীরা তাঁকে এই গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি এড়িয়ে যেতে চাপ দিচ্ছিল। তাঁরা শুধু হাসপাতালের একটি কাগজ পাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন ছিল, যেখানে বলা থাকবে যে আরশাদ মারা গেছেন। আর সেটাই যেন পুরো বিষয়টির সমাপ্তি। মৃত্যুসনদে লেখা ছিল আরশাদের মৃত্যুর কারণ ‘অজানা (মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে)’ এবং সেখানে মৃত্যুর সময়ের কোনো উল্লেখ ছিল না। মৃত্যুর কারণ নির্ধারণের জন্য ময়নাতদন্তের কোনো নমুনা সংগ্রহের চেষ্টাও করা হয়নি।

তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের একটি দায়িত্ব পালন করেছিল। তারা জোর দিয়েছিল যে দেহটি অবশ্যই পরিবারের একজন সদস্যের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, এসকেএফের কর্মীদের কাছে নয়। শাযরেহর স্বামী মরদেহের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে আগ্রহী ছিলেন। তাই তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং দেহের হেফাজত গ্রহণ করেন। কিন্তু মৃত্যুসনদ তাঁর কাছে দেওয়া হয়নি। কারণ সিমিন এটি তাঁর সংরক্ষণের জন্য রাখতে চেয়েছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আবারও এসকেএফের কর্মীদের দাবির সঙ্গে সম্মতি জানাতে বাধ্য হয়।

সেদিনের পুরো ঘটনাপ্রবাহ কি আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়? সুতরাং এটা পুরোপুরি বোঝা যায়, কেন শাযরেহ তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুকে সন্দেহজনক মনে করে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলাটি পরবর্তী সময়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয় এবং তদন্তকারী দল বিষয়টি গভীরভাবে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সিমিনের ট্রান্সকম গ্রুপ মাফিয়া

তবে ট্রান্সকমের অর্থ ও প্রভাব, যা প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের মাধ্যমে বিস্তৃত, নিশ্চিত করেছে যে তদন্ত যেন স্বাভাবিক গতিপথে চলতে না পারে। আরশাদের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করা উচিত ছিল। কিন্তু পিবিআই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে শাযরেহ নাকি তাদের বহুবার মৌখিকভাবে অনুরোধ করেছেন এটি না করার জন্য। এটা কি আপনাদের কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়?

পিবিআইয়ের উচিত ছিল আরশাদের গাড়িচালক ও বাসায় থাকা রাঁধুনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা। কিন্তু তারা তা করেনি। এর পরিবর্তে তারা শুধু সেই গৃহপরিচারিকার বক্তব্য নিয়েছে, যিনি দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য আসেন এবং তাঁর মা ও সিমিনের গৃহকর্মীদের বক্তব্য নিয়েছে, যাঁদের এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি কোনো সংযোগ নেই। এমনকি তাঁদের বক্তব্যেও স্পষ্ট অসংগতি রয়েছে। অবাক করার বিষয় হলো, পিবিআই কোনোভাবেই এফআইআরে উল্লেখিত ১১ জন অভিযুক্তের কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ না করেই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।

শাযরেহ তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুতে পিবিআইয়ের ত্রুটিপূর্ণ প্রতিবেদনের যুক্তিসংগত বিরোধিতা করেছেন। তিনি চান যে তদন্ত যেন নতুন করে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সম্পন্ন করা হয়। এটি একটি ন্যায্য এবং যুক্তিসংগত দাবি নয় কি? কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, শাযরেহ বাধার দেয়ালে আঘাত খেতে থাকবেন এমনকি বাংলাদেশ ২.০ আমলেও। আপনারা জানেন কেন? কারণ সরকারে এমন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন, যিনি প্রথম আলো এবং সমাজে প্রভাবশালী মতিউর রহমান ও মাহ্ফুজ আনামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এই পৃথিবী সিমিনের হাতের মুঠোয়। এটি একদম ডেভিড বনাম গোলিয়াথের পরিস্থিতি। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেখানে আমরা চাই ডেভিড অর্থাৎ মিসেস শাযরেহ হক, ন্যায়বিচার পাক। এক ইঞ্চিও বেশি বা কম নয়।

সিমিনের ট্রান্সকম গ্রুপ মাফিয়া

আমি আপনাদের জন্য তিনটি অতিরিক্ত তথ্য দিচ্ছি

আরশাদের মৃত্যুর মাত্র চার দিন পর তাঁর মা এবং সিমিন বোর্ড মিটিং শুরু করেন। তাঁর মা নিজের ১০০টি শেয়ার ট্রান্সকম গ্রুপের সিএফও ও কোম্পানির সচিব কামরুল হাসানকে দেন, যাতে কামরুল আরশাদের বোর্ড আসনটি দখল করতে পারেন। অথচ কামরুল এফআইআরে উল্লেখিত মূল অভিযুক্তদের একজন।

আরশাদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটটি এখনো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তাঁর রাঁধুনি ও গাড়িচালক এখন পুরোপুরি ট্রান্সকমের স্থায়ী কর্মী হয়ে গেছেন এবং তাঁরা ওই ফ্ল্যাট ব্যবহার করছেন। আরশাদের মৃত্যুর ৪০ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে সিমিন তাঁর ছেলে যারাইফ আয়াত হোসেনের জন্য এক বিশাল জমকালো বিয়ের আয়োজন করেন। এমনকি লোক দেখানোর জন্য হলেও তিনি নিজের ভাইয়ের জন্য ৪০ দিনের শোকের সময়টুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। এটি প্রমাণ করে যে আরশাদের মৃত্যু তাঁকে কতটা নাড়া দিয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button