International

সিরিয়াকে নিয়ে কী হিসাব-নিকাশ কষছে বিশ্ব পরাশক্তি ?

বাশার আল আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে এরই মধ্যে সিরিয়াতে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে পরাশক্তি রাশিয়া ও ইরান। এর মধ্যেই অঞ্চলটিতে আরেক ধাক্কা খেতে যাচ্ছে আরেক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। আর উভয় পরাশক্তির এমন দুর্দশার পেছনে আছে তুরস্ক। সিরিয়ার তুর্কি আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এবার আটঘাট বেঁধে নেমেছে আঙ্কারা।

বিদ্রোহীদের মাত্র ১২ দিনের ‘ঝোড়ো’ অভিযানে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন হয়েছে। আসাদ পালিয়ে মিত্র দেশ রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। এর মাধ্যমে দেশটির ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ ও আসাদ পরিবারের ছয় দশকের স্বৈরশাসনের অবসান হয়।

সিরিয়ার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে মধ্যপ্রাচ্যের মোড় ঘুরানো ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আসাদের পতনে সিরিয়া ঘিরে এতদিন যে ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ ছিল তা পুরোপুরি বদলে গেছে। পুরোনো বন্দোবস্ত বাতিল হওয়ায় দেশটি ঘিরে নতুন করে হিসাব-নিকাশ কষতে শুরু করেছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো।

আধুনিক ইতিহাসে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের মতো এত জটিল ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র খুব কমই আছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে সাড়ে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। এক যুগ আগে জনগণের শান্তিপূর্ণ বিপ্লব দমনে আসাদ সরকার কঠোর দমন-পীড়ন শুরু করলে সেটি আন্তর্জাতিক গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। সিরিয়া যুদ্ধক্ষেত্র হলেও মূল খেলোয়াড় বনে যায় রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ।

গত রোববার (৮ ডিসেম্বর) ক্ষমতাচ্যুত হন আসাদ। মাত্র ১২ দিনের ‘ঝোড়ো’ অভিযানে রাজধানী দামেস্ক দখল করে নেয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। তাদের নেতৃত্ব দেয় হায়াত তাহরির আল-শামস (এইচটিএস)। এখন তারা দেশে সরকার গঠনের তৎপরতা শুরু করেছেন।

এ যেন আমেরিকার হাতে রাশিয়ার পরাজয়! পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গনে প্রতিটা চাল যেন পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের মর্জিমাফিক। আপাতত সেখান থেকে ‘ল্যাজ গুটিয়ে’ পালানো ছাড়া মস্কোর সামনে দ্বিতীয় রাস্তা খোলা নেই। ইরানের অবস্থাও তথৈবচ। অন্য দিকে, এই পরিস্থিতিতে ‘লাভের গুড়’ কতটা খাওয়া যায়, তার হিসাব কষতে শুরু করেছে ওয়াশিংটন।

সিরিয়ায় বাশার-আল-আসাদ সরকারের পতনকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের দাবি, বিদ্রোহীদের দামাস্কাসে ঢুকে পড়া আসলে আমেরিকারই জিত। এ বার অতি সহজেই ‘হট কেকে ছুরি চালানোর’ মতো করে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে ‘রাজত্ব’ করতে পারবে ওয়াশিংটন।

আসাদ বাহিনীর এত দ্রুত পতনে হতবাক হয়েছে রাশিয়া ও ইরান। বিষয়টি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দপ্তর ক্রেমলিনও স্বীকার করেছে। গত সোমবার সিরিয়ায় গত কয়েক দিনের নাটকীয় ঘটনাবলির বিষয়ে সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ স্বীকার করেন যে, ক্রেমলিন হতবাক হয়েছে। তিনি বলেন, যা ঘটেছে, তা পুরো বিশ্বকে হতবাক করেছে। এই ক্ষেত্রে আমরাও ব্যতিক্রম নই।

বলতে গেলে দীর্ঘদিনের মিত্র আসাদের পতন ঠেকাতে তেমন কিছু করতে পারেনি মস্কো ও তেহরান। গত ৭ ডিসেম্বর দোহায় অনুষ্ঠিত আস্তানা ফরম্যাটের এক বৈঠকে ইরান ও রাশিয়ার প্রতিনিধিরা তুরস্কের কাছে সিরিয়া যুদ্ধে হারের বিষয়টি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে হয়।

আসাদ সরকারের পতনের ফলে ইরান তার শিয়া ক্রিসেন্টের (মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াপ্রধান অঞ্চল) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হারিয়েছে। লেবানন ও পুরো লেভান্টে (পূর্বদিক) আধিপত্য বিস্তারে এতদিন সিরিয়া হয়ে যে স্থলপথটি ব্যবহার করত দেশটি, সেটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি সংঘাতেও ইরানের ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। কারণ তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থান হারিয়েছে। এখন ইরান হয়তো নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে বাধ্য হবে অথবা তারা তাদের আঞ্চলিক শক্তি খর্বের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করতে পারে।

ব্রিটেনের চ্যাথাম হাউসের ক্রিস্টোফার ফিলিপস পলিটিকো বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হিজবুল্লাহ ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলে ইরানও অনেক দুর্বল। অন্যদিকে রাশিয়া অনেক সেনা ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। কোনো মিত্রই অতীতের মতো আসাদের সমর্থনে সহায়তা পাঠাতে পারেনি। তাই আসাদ বাহিনী দুর্বল হয়ে যায়।

অন্যদিকে ১৩ বছরের পুরোনো সিরিয়ান গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে তুরস্ক। আঙ্কারা দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থান দুর্বল করতে পেরেছে এবং এখন সিরিয়ার মধ্য দিয়ে ইউরোপ ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সংযোগকারী একটি ভূখণ্ডে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে এরদোয়ানের দেশ।

একই সঙ্গে এরদোয়ান নিজের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা সামনে এগিয়ে নিতে পারবেন। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনসহ বেশ কয়েকটি কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ পাবেন তিনি। সিরিয়ার প্রয়োজনীয় পুনর্গঠনের সুযোগে তুর্কি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারও ঘটবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button