সিলেট বিভাগে ১২১ মামলায় ‘দৌড়াচ্ছেন’ ৭ হাজার নেতাকর্মী
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিএনপি নেতাকর্মীর জামিন না হওয়ায় চারটি মামলায় সিলেট জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালতে পৃথক আবেদন (মিস কেস) করা হয় বৃহস্পতিবার। একটি মামলার শুনানি শেষে পাঁচজনের মধ্যে চারজনের জামিন দেন আদালত। একই দিন মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরও তিনটি মামলার জামিন শুনানি হয়। এ তিনটি মামলায় ১৫ নেতাকর্মীর জামিনের শুনানি হলেও কেউ জামিন পাননি। এভাবে প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলার জামিন শুনানি হচ্ছে। কোনো কোনো মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন না পেয়ে জজ আদালতে আবেদন করা হচ্ছে। কাউকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আবার হাজিরার দিন কারাগার থেকে আদালতে নেওয়া হচ্ছে।
শুধু সিলেট আদালতের চিত্রই এমন নয়। বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ আদালতেও প্রতিদিন কোনো না কোনো মামলায় হাজিরা দিচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মী। বিভাগের ৪২টি থানায় করা শতাধিক মামলায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় ৭ হাজার নেতাকর্মী আসামি। তাদের আইনি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বিএনপির আইনজীবী প্যানেল।
বিএনপির তথ্য সেল ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবরের পর সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকার ছয়টি থানাসহ বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মোট ১২১টি মামলা হয়। আসামিদের অনেকে কারাগারে, কেউবা পলাতক। আবার উচ্চ আদালতে যাচ্ছেন অনেক নেতাকর্মী। গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন মামলায় শতাধিক নেতাকর্মী উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন। কিন্তু অনেকে শুনানির সিরিয়াল পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন।
সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও আইনজীবী প্যানেলের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী সমকালকে জানিয়েছেন, ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর তারা সিলেটে প্রথম নেতাকর্মীকে আইনি সহায়তা দিতে আইনজীবী প্যানেল করেন। এখন অন্যান্য জেলায়ও করা হয়েছে। পরে দলীয় নির্দেশনাও আসে। প্রতিদিনই একাধিক মামলায় নেতাকর্মী আদালতে আসেন। তিনি বলেন, দলের কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে পেরে তারা খুশি। তিনি জানান, অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও আইনজীবী রেখেছেন। শীর্ষ নেতারা প্যানেলকে সহায়তা করছেন। এমনকি যুক্তরাজ্য স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা রফি আহমদ চৌধুরী বেশ কয়েকটি মামলায় সহায়তা করেছেন। মৌলভীবাজার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান জানান, তিনি উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের অনেক নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন। প্রতিদিন কেউ জামিন নিতে কেউবা হাজিরা দিতে আদালতে যান।
১৩২টি মামলার মধ্যে সর্বোচ্চ সিলেট জেলায় ৬৮টি মামলা হয়। ২৯ অক্টোবর প্রথম মামলা হয় সিলেটের জকিগঞ্জ থানায়। ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশে সংঘর্ষের জেরে ওই দিন রাতে কালীগঞ্জ বাজার রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ৬৮ মামলার মধ্যে মহানগর পুলিশের ছয়টি থানায় ৪৯টি ও ১৩ উপজেলায় ১৯টি মামলায় আসামি অজ্ঞাতপরিচয়সহ প্রায় চার হাজার। গাড়ি ভাঙচুর, নাশকতা, বিস্ফোরণ, ট্রেনে আগুন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস, সরকারি কাজে বাধা, জনগণের চলাচলে বাধাসহ বিভিন্ন অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে। এসব মামলায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন। জামিন পেয়েছেন হাজারখানেক নেতাকর্মী। বাকিরা পলাতক।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৮টি মামলা হয় সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন থানায়। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ১ হাজার ৮৯। ৪২৩ জনের নাম উল্লেখ করে ৬৬৬ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়। প্রায় ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন ২৫ থেকে ৩০ জন। গত বুধবার জামিন নিতে আদালতে যান জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন। জেলায় বিএনপির আইনজীবী প্যানেল করা হয়েছে।
অ্যাডভোকেট শেরে নুর আলী ও অ্যাডভোকেট মইন উদ্দিন সুহেলসহ কয়েকন আইনজীবী আইনি সহায়তা করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন জেলার সহসভাপতি আনিসুল হক। তিনি বলেন, জেলার ভাটি অঞ্চলের থানা থেকে নেতাকর্মীর আদালতে আসতে যেমন কষ্ট হয়, তেমনি প্রচুর অর্থ খরচ হয়। আমরা তাদের সেই খরচ না দিলেও আইনি সহায়তা দিচ্ছি।
হবিগঞ্জ জেলায় ২৮ অক্টোবরের পর মামলা হয় ১৬টি। এসব মামলায় আসামি হাজার খানেক। শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন ৩০ থেকে ৩৫ জন। দলের পক্ষ থেকে অ্যাডভোকেট আফজাল, আব্দুল হাই ও অ্যাডভোকেট এনামুল হক সেলিম আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। দলের জেলা যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক সেলিম জানান, বিশেষ কিছু মামলায় উচ্চ আদালতে জামিনের জন্য ইতোমধ্যে ২০টি আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু শুনানির তারিখ পাওয়া যাচ্ছে না।
সবচেয়ে কম মামলা হয়েছে মৌলভীবাজার জেলায় ৯টি। এসব মামলায় আসামির ৪০০-৫০০। গ্রেপ্তার করা হয় ৬০ থেকে ৬৫ জনকে। ইতোমধ্যে জামিন নিয়েছেন বেশ কয়েকজন। বিএনপির জেলা সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান জানান, অনেকে উচ্চ আদালতে যাচ্ছেন। তিনিও দুটি মামলায় উচ্চ আদালতে যাবেন। দলীয় আইনজীবী ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে মামলায় সহায়তা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তবে দলের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তায় নেতাকর্মীরা খুশি হলেও তারা অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারা জানিয়েছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাম্প্রতিক সময়ের মামলা ছাড়াও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের আন্দোলনে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। সেইসব মামলায় তারা আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। তবে এসব মামলার কোনোটি শেষ হয়েছে আবার কোনোটি শেষ হওয়ার পথে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী।
কারাগারে শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা
সিলেট বিভাগের শীর্ষস্থানীয় নেতার মধ্যে করাগারে সিলেট জেলায় বেশি। এর মধ্যে আছেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, সাবেক আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পঙ্কি, জেলা যুবদলের সভাপতি মুমিনুল ইসলাম মুমিন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আবদুল আহাদ খান জামাল, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মাহবুবুল হক চৌধুরী, সদস্য সচিব আফসর খান, মহানগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী আহসান। এ ছাড়া মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলামসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বেশ কিছু নেতাকর্মী রয়েছেন। ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ জেলা যুবদলের সভাপতি আবুল মুনসুর মোহাম্মদ শওকত, ছাত্রদলের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তারেকসহ মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে কিছু নেতাকর্মী জামিন নিয়েছেন। সর্বোচ্চ অর্ধশত মামলার আসামি হয়েছেন সিলেট জেলা ও মহানগর ছাদত্রদলের দুই সাধারণ সম্পাদক।
নেতাকর্মীকে আইনি সহায়তা ও হয়রানি প্রসঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, আমরা শুধু নেতাকর্মীকে আইনি সহায়তা দিচ্ছি না, যারা আহত হয়েছেন তাদেরও সহায়তা করছি। কারাগারে যারা আছেন তাদের পরিবারের খবরও নেওয়া হচ্ছে। এতে দলীয় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছেন। সিলেট বিভাগের সাত হাজার নেতাকর্মী আসামি। এতে প্রমাণ হয়েছে, হামলা-মামলা করে আন্দোলন ঠেকানো যায় না। তিনি জানান, ৮০ ভাগ মামলাই দলীয় আইনজীবীরা পরিচালনা করছেন।