Trending

সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের অভিমত

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আগে বাজারে শৃঙ্খলা আনতে হবে -ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ * ঋণের সুদ আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়, ১২ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা উচিত -ড. মইনুল ইসলাম

ঋণের সুদহার পাগলা ঘোড়ার গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। আট মাসে সুদ ৮-৯ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন হয়েছে সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশের বেশি। ওই সময়ে সুদ বেড়েছে সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি। ঋণের সুদের হার বাড়ায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। একদিকে ডলারের দাম বাড়ায় ব্যবসায় খরচ বেড়েছে। এর মধ্যে সুদের হার বাড়ায় তা আরও উসকে দিচ্ছে। খরচ বাড়ায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে পণ্যের দাম বাড়ালে বিক্রি কমে যাচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ করা অর্থ ফিরে আসছে না। ফলে ঋণের টাকা পরিশোধ করা নিয়ে এখন বড় দুশ্চিন্তায় উদ্যোক্তারা। কারণ, ১৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে যে মুনাফা হবে, তা দিয়ে কোম্পানির ব্যয় মিটিয়ে ব্যাংক ঋণ শোধ করা কঠিন হবে।

সব মিলে উভয় সংকটে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। এদিকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদের হার বাড়ানো হলেও বাস্তবে মূল্যস্ফীতি কমছে না। উলটো বেড়ে যাচ্ছে। এতে ভোক্তার ওপর চাপ আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে দুই অর্থবছর ধরে। এর মাধ্যমে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হচ্ছে। ঋণের সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, টাকার প্রবাহ কমালে মূল্যস্ফীতির হার কমবে। এখন চড়া মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আনতেই মূলত সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে টাকার প্রবাহ কমানো হচ্ছে। কিন্তু সুদের হার বাড়ার আট মাস চলছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। উলটো তা বেড়ে যাচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদের হার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। অন্যান্য দেশে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। ওইসব দেশে এ নীতি কাজ করছে। সেই মডেলটিই এখন বাংলাদেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই মডেলটি কখনোই কাজ করে না। অতীতেও সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এখনো সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ, বাজার ব্যবস্থাপনা অর্থনীতির নিয়ম মেনে চলে না। যেহেতু বাজারে অর্থনীতির নিয়ম অচল, সে কারণে টাকার প্রবাহ কমিয়ে ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে হবে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম বন্ধ করতে হবে। তাপরই কেবল পণ্যমূল্য কমতে পারে। তখন স্বাভাবিক নিয়মেই মূল্যস্ফীতির হার কমে যাবে। এখন মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়িয়ে টাকার প্রবাহ কমানোর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আমদানি ব্যয় বাড়ছে। পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে বাজারে চাপ আরও বেশি বাড়ছে। ফলে মূল্যস্ফীতিতেও চাপ তৈরি হচ্ছে। আরও ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এতে মানুষের আয় বাড়ানোর পথ সুগম হচ্ছে না। ফলে মানুষ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, আমানত ও ঋণের ৬-৯ সুদহার তুলে দেওয়ার পর থেকে ঋণের সুদের হার বেশি মাত্রায় বাড়ছে। ৮-৯ শতাংশ থেকে বেড়ে তা এখন সাড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশে উঠেছে। আট মাসের ব্যবধানে সুদের হারের এত বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই কাম্য নয়। সুদের হার বাড়লেও মূল্যস্ফীতির হার কমেনি।

তিনি আরও বলেন, একদিকে চড়া সুদের ফলে মূল্যস্ফীতির হার কমেনি, অন্যদিকে এত সুদে ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়ছেন। কারণ, এত সুদে ঋণ নিয়ে যে লাভ করছেন, তা থেকে সুদসহ ঋণের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে ঋণখেলাপির প্রবণতা বেড়ে যাবে। আর বাংলাদেশের মতো দেশে ঋণের সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর জন্য বাজার ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে শৃঙ্খলা আনতে হবে। তাহলে পণ্যের দাম যৌক্তিক হবে। তখন মূল্যস্ফীতির হার কমবে।

তিনি আরও বলেন, ঋণের সুদের হার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এদিকে বেশি সুদে উদ্যোক্তারা ঋণ নেওয়া কমিয়ে দেওয়ায় কর্মসংস্থান কমে গেছে। এতে মানুষের আয় কমছে। বেকারদের চাকরি হচ্ছে না। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিও কমছে না। এতে দুদিক থেকেই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ঋণের সুদের হার আর না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এ হার ১২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাই যুক্তিযুক্ত হবে। এর বেশি বাড়লে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। আবার ৯ শতাংশের মধ্যে সুদের হার বেঁধে দেওয়া ঠিক ছিল না। একে সীমিত পরিসরে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে কিছুটা ওঠানামা করতে দেওয়া উচিত।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম নুরুল আমিন বলেন, দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এখন বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে সুদের হার নির্ধারণের জন্য করিডর প্রথা ঘোষণা করেছে। এতে সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যাংক ঋণের সুদ নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দায় সরকারের রাজস্ব আয় কম হচ্ছে। এতে সরকার বেশি ঋণ নিচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকায় ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিতে পারছে না। যে কারণে ট্রেজারি বিলের সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ঋণের সুদও বাড়ছে। এ পদ্ধতি আরোপের কারণে সুদ আগে যেখানে ৮-৯ শতাংশ ছিল, এখন তা বেড়ে সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশে উঠেছে। সুদের হার বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। এটি করা যাচ্ছে না। ফলে সুদ বাড়ানোর সুফল সাধারণ ভোক্তা পাচ্ছে না। ব্যবসায় খরচ বাড়ায় পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে উলটো তারা ক্ষতির মুখে পড়ছে।

তিনি বলেন, সুদের হার বাড়িয়ে টাকাকে ব্যয়বহুল করা হচ্ছে। এতে উদ্যোক্তারা ঋণ কম নেবে। ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমবে। এতে চাহিদা কমবে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার কমে আসবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের এ পদ্ধতি সঠিক নয়।

তিনি আরও বলেন, সুদের হার বাড়ানোর কারণে ঋণ নেওয়া কমে যাচ্ছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমেছে। ফলে মানুষের আয়ের সুযোগও কম হবে। ব্যাংকের ব্যবসাও কমে যাবে।

তার মতে, তারল্য সংকটের কারণে সুদের হার হয়তো আরও বাড়তে পারে। তবে এটিকে আর বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d