Bangladesh

সুন্দরবন সুরক্ষায় তিন প্রকল্প

অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময় সুন্দরবন প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদকুলও বৈচিত্র্যময়। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই সুন্দরবনের সুরক্ষা ও বনের জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সুন্দরীগাছের আগামরা রোগ নির্ণয়, বনের প্রাণী ও উদ্ভিদকুল এবং জলজ সম্পদ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে এই গবেষণার কাজ চলছে। প্রকল্প তিনটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ২২২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। বন বিভাগের পক্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, প্রকল্প তিনটি বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, সুন্দরীগাছের আগামরা রোগের কারণ নির্ণয় এবং প্রাণিকুলের জীবনচক্র ও জলজ সম্পদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।

তবে গবেষকেরা বলছেন, সুন্দরবন নিয়ে যে গবেষণা হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

সুন্দরবন_পশ্চিম_বন্যপ্রাণী_অভয়ারণ্য

সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনে বর্তমানে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প এবং সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প।

সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মাধ্যমে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে করমজল, কটকা, কচিখালী, দুবলা, হারবাড়িয়া, কলাগাছিয়ার উন্নয়নসহ পাশাপাশি নতুন চারটি পরিবেশবান্ধব পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। এই নতুন চারটি  পর্যটনকেন্দ্র (ইকোট্যুরিজম) হচ্ছে আন্দারমানিক, আলীবান্দা, কালাবগি ও শেখেরটেক। এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ২৮ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এটি শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। সূত্রমতে, এই প্রকল্পের ৮০ ভাগ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।

সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পটি ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়েছে। এটির কাজ শেষ হবে আগামী বছরের ডিসেম্বরে। এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে, ১৫৭ কোটি ৮৭ লাখ ৫১ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বন বিভাগের ২৮টি নতুন ক্যাম্প ও দুটি রেঞ্জ অফিস নির্মাণ। এছাড়া সুন্দরবনের আশপাশের লোকালয়ে বন বিভাগের যেসব জায়গা রয়েছে, সেখানে সামাজিক ও ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা। এই বনায়ন থেকে স্থানীয় মানুষের জ্বালানিসহ কাঠের চাহিদা পূরণ হবে। ফলে সুন্দরবনের কাঠ কাটা বন্ধ হবে। পাশাপাশি সুন্দরবনসংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা ও আড়ুয়াবেড় নদী এবং ভুরা ও খরমা খাল পুনর্খনন করা হবে। এর পাশাপাশি সুন্দরবনকেন্দ্রিক কিছু গবেষণা ও জরিপকাজ এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

সুন্দরবন-06

সূত্রমতে, এই প্রকল্পে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবনের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব, সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরীগাছের আগামরা রোগ নির্ণয়, বন্যপ্রাণীর জীবনচক্র, সুন্দরবনের লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণ, ভেজিটেশন, সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল এবং জলজ সম্পদের ওপর গবেষণা করা হচ্ছে। এছাড়া সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পটি শুরু হয়েছে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে। এই প্রকল্প ২০২৫ সালের মার্চে শেষ হবে। এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের বাঘশুমারি করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শিকার প্রাণী, অর্থাৎ বাঘের খাদ্য হরিণ, শূকর, কাঁকড়া—এসব প্রজাতির জরিপ ও রোগবালাই সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ের ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের সদস্যদের (বাঘ লোকালয়ে এলে যারা বনে ফেরত পাঠায়) প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া সুন্দরবনসংলগ্ন যেসব লোকালয় রয়েছে, সেখানে নাইলনের নেটিং (জাল) তৈরি করা হবে। তবে, বর্ষা মৌসুমের কারণে আপাতত বাঘশুমারির কাজটি বন্ধ রয়েছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই বাঘশুমারির কাজ আবার শুরু হবে।

সুন্দরবন বন বিভাগের পক্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, উক্ত প্রকল্প তিনটি বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, সুন্দরীগাছের আগামরা রোগের কারণ এবং সুন্দরবনে ধারণক্ষমতা অনুযায়ী বাঘ, হরিণ, শূকর, বানরসহ প্রাণিকুলের জীবনচক্র ও জলজ সম্পদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হবে।

সুন্দরবন

বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন সোনাতলা গ্রামের বাসিন্দা ও ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের সদস্য খলিলুর রহমান জমাদ্দার বলেন, ২০০৮ সাল থেকে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের সদস্য হিসেবে কাজ করছি। তবে এখনো বন বিভাগের পক্ষ থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে হলে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের সদস্যদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা জরুরি।

সুন্দরবনের কোলঘেঁষা খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউপি চেয়ারম্যান সুদেব কুমার রায় বলেন, সুন্দরবন ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে বন বিভাগকে আরও বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য প্রথমেই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া সুন্দরবনের নদ-নদী, খাল ও নিষিদ্ধ এলাকায় বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার বন্ধ এবং সুন্দরবনের বাঘ ও হরিণসহ বন্যপ্রাণী শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এটা করা সম্ভব হলেই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।   

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সুন্দরবন একটি বিশাল সম্পদের আধার। এই বনের ৩৩ শতাংশই জলাভূমি। শুধু সুন্দরবনের উপরিভাগ নয়, সুন্দরবনের জলাভূমিতেও রয়েছে বিশাল জলজ সম্পদ, যার অধিকাংশই রয়েছে আমাদের অজানা। তবে বর্তমানে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও জলজ সম্পদ নিয়ে প্রকল্পভিত্তিক ও বিদেশি অনুদানে কিছু গবেষণা করা হচ্ছে। সুন্দরবন একাডেমির পক্ষ থেকেও সুন্দরবনের ওপর কিছু কিছু গবেষণার কাজ করা হয়। কিন্তু এসব গবেষণা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও জলজ সম্পদ নিয়ে বহুমাত্রিক ও সমন্বিতভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। গবেষণার পাশাপাশি সুন্দরবন সুরক্ষার ওপর বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাই আমরা সরকারের কাছে সুন্দরবনের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় করার দাবি জানিয়ে আসছি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ রকিবুল হাসান সিদ্দিকী সুন্দরবনের গবেষণা সম্পর্কে বলেন, সুন্দরবন নিয়ে নানাবিধ গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তথাপি বড় ধরনের গবেষণার অভাব, বিশেষত পরিবেশগত বিষয়ের গবেষণার বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুন্দরবনের তাপমাত্রা, জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা, পলির পরিমাণ ও পানির গুণাগুণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও এর পরিবর্তনে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও গাছপালার ওপর কীরূপ প্রভাব পড়ছে তা নিরূপণ করা জরুরি। এছাড়া সুন্দরবনের মধ্যে যেহেতু কয়লা ও জ্বালানি তেল পরিবহন দুর্ঘটনা নিয়মিত ঘটছে, তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণ করাও জরুরি।

সুন্দরবন-05

তিনি বলেন, সুন্দরবন সহব্যবস্থাপনা এক যুগ অতিক্রম করেছে, এর সফলতা দেখা জরুরি। পাশাপাশি এর ব্যর্থতা থাকলে তা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, তা দেখাও অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ রকিবুল হাসান সিদ্দিকী আরও বলেন, প্রায়ই সুন্দরবনে মৌসুমি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়; বনজীবীদের জীবনযাত্রার ওপরে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নিয়েও গবেষণা হওয়া দরকার বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সুন্দরবন বন বিভাগের সংরক্ষক (সিএফ) আশিষ কুমার দো জানান, সরকারিভাবে সুন্দরবনে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের মধ্যে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়েও গবেষণার কাজ রয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, সুন্দরীগাছের আগামরা রোগের কারণ নির্ণয় এবং প্রাণিকুলের জীবনচক্র ও জলজ সম্পদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনের আশপাশের লোকালয়ে বন বিভাগের যেসব জায়গা রয়েছে, সেখানে সামাজিক ও ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হবে। এই বনায়ন থেকে স্থানীয় মানুষের জ্বালানিসহ কাঠের চাহিদা পূরণ হবে। ফলে সুন্দরবনের কাঠ কাটা বন্ধসহ এর ওপর স্থানীয় মানুষের চাপ অনেকটাই কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor