সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল:কিডনি প্রতিস্থাপনে জাল নথি, তদন্তে প্রমাণ পেল কমিটি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। সম্প্রতি তোলা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনে যে জাল নথিপত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
তদন্ত কমিটি বলেছে, দাতা ও গ্রহীতা স্বীকার করেছেন তাঁরা নিজেদের স্বার্থে জাল নথিপত্র তৈরি করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশান সনদ, বৈবাহিক সনদ ও সাক্ষী—সবকিছুই ভুয়া ছিল।
অবশ্য তদন্ত কমিটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি। আর প্রতারক চক্রকে শনাক্ত করতে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন বলে মনে করে কমিটি।
বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় গত ১৭ জুলাই। নতুন হাসপাতালে প্রথমবারের মতো কিডনি প্রতিস্থাপনের সেই খবর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়েছিল, পিরোজপুরের বাসিন্দা ৪২ বছর বয়সী সুজন রায় কিডনি গ্রহণ করেছেন। আর কিডনি দিয়েছেন তাঁর ছোট ভাই ৩১ বছর বয়সী সুসেন রায়।
বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলো অনুসন্ধান করে জানতে পারে, কিডনিদাতা সুসেন রায় নন, তাঁর প্রকৃত নাম সুমিত হাওলাদার। সুমিতের স্ত্রী ও ভাই বিষয়টি জানতে পেরেছেন টেলিভিশনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনে সাফল্যের খবর দেখে।
বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোতে গত ১৯ জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘বিশেষ হাসপাতালে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন মিথ্যা পরিচয়ে’। অনলাইন সংস্করণে শিরোনাম ছিল, ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল: সুসেন নাম দিয়ে নেওয়া হলো সুমিতের কিডনি, ভাই ও স্ত্রী জানলেন টেলিভিশন দেখে’।
জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশান সনদপত্র, বৈবাহিক সনদপত্র দিয়ে থাকে আইন মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। আমরা তাদের এসব সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও বেশি যত্নবান হতে চিঠি দেব।
অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য, বিএসএমএমইউ
প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি তদন্তের জন্য বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এর প্রধান করা হয় হাসপাতালের হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রিয়াটিক অ্যান্ড লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মহছেন চৌধুরীকে।
বিএসএমএমইউ সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সদস্যরা গত ২০ ও ২৩ জুলাই পরপর দুটি বৈঠক করেন। তাঁরা কিডনিদাতা, গ্রহীতা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কর্মকর্তা এবং কিডনি প্রতিস্থাপন দলের প্রধানের সাক্ষাৎকার নেন।
তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক (আইন) তানিয়া আক্তারকে ডেকে তাঁর কাছে থাকা সংশ্লিষ্ট কিডনি প্রতিস্থাপন দলের আইনগত যাবতীয় নথিপত্র সংগ্রহ করে যাচাই করে দেখে। উল্লেখ্য, তানিয়া আক্তার সংশ্লিষ্ট কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য।
তদন্ত কমিটি তদন্ত ও যাচাই-বাছাই শেষে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শাখা ও ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তর থেকে পাওয়া নথিপত্র আপাতদৃষ্টিতে সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। তবে দাতা ও গ্রহীতার সাক্ষাৎকার অনুযায়ী তাঁরা নথিপত্র জাল করেছেন।
কমিটি আরও বলেছে, প্রতারক চক্র প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের দাতা সরবরাহ করে বলে কথিত আছে। সে বিষয়ে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন।
তদন্ত কমিটি বলেছে, দাতা ও গ্রহীতা স্বীকার করেছেন তাঁরা নিজেদের স্বার্থে জাল নথিপত্র তৈরি করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশান সনদ, বৈবাহিক সনদ ও সাক্ষী—সবকিছুই ভুয়া ছিল।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশান সনদপত্র, বৈবাহিক সনদপত্র দিয়ে থাকে আইন মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। আমরা তাদের এসব সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও বেশি যত্নবান হতে চিঠি দেব।’ তিনি বলেন, এ ধরনের চক্রকে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকবে।
প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা দিতে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। এতে ব্যয় হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর এই হাসপাতালের উদ্বোধন করেন।