Bangladesh

সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দিয়ে প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা!

‘বোয়ালখালীতে লাঙ্গলকে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করেছেন আ.লীগের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী’

‘চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনে সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাসে এমপি ও দলীয় নেতাসহ বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র থেকে দাঁড়ানো প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের জন্য সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঠ প্রশাসন ‘নিষ্ঠুর’ খেলা খেলেছে। কোথাও সুষ্ঠু ভোট হয়নি। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার লোকজনকেই জয়ী করে আনতে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।’

চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনে হেরে যাওয়া হেভিওয়েট প্রার্থী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ এমন অভিযোগ করেছেন। আগে জানলে সরকারের এমন পাতা ‘ফাঁদে’ পা দিতেন না বলেও জানান তারা। প্রভাবিত এই নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ফলে দলীয় (আ.লীগ) নেতাকর্মীদের মধ্যেই বিভেদ তৈরি হয়েছে। এই বিভেদ দীর্ঘদিন থাকবে। যার মাশুল গুনতে হবে সররকারি দলকেই। ঘরের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া ‘বিভীষণ’ দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে জোটের স্বার্থে নৌকা প্রত্যাহার করে লাঙ্গলকে সমর্থন দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হলেও এ আসনে আওয়ামী লীগ লাঙ্গলের পাশে ছিল না। বরং আওয়ামী লীগেরই দুই প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচন করে লাঙ্গলের প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠের হার নিশ্চিত করেন। এ প্রসঙ্গে সোলায়মান শেঠ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মনে করি এটা করে প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে অমান্য করা হয়েছে। যারাই এটা করেছে তারা ঠিক করেননি। এটা রাজনৈতিক শিষ্টাচার নয়। এই আচরণ থেকে পরবর্তী জেনারেশন কী শিখবে।’

৭ জানুয়ারির নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ১২টিতে নৌকার প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। ৩টিতে স্বতন্ত্র ও একটিতে লাঙ্গলের প্রার্থী জিতেছেন। চট্টগ্রামের মীরসরাই, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, পটিয়া, বোয়ালখালী, ফটিকছড়ি, নগরীর ডবলুমরিং, বন্দর-পতেঙ্গা, চান্দগাঁও বোয়ালখালী, সন্দ্বীপ আসনে পরাজিত প্রার্থীরা বলেছেন তারা প্রতারিত হয়েছেন। ভোটের আগের দিন পর্যন্ত সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দিয়ে প্রার্থীদের অন্ধকারে রেখে ভোটের দিন ‘গণেশ’ উলটে দেওয়া হয়েছে। তারা বলেন, বৃহৎ দল বিএনপি ভোটে ছিল না। যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের। কেউ দলীয় প্রতীক নিয়ে, কেউ বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ভিন্ন প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন। আবার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে, সমমনা, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কিছু রাজনৈতিক দলকেও নির্বাচনের মাঠে নামানো হয়েছে। নতুন দল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে নিবন্ধনও। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরামসহ বিভিন্ন দল নির্বাচনে অংশ নেয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী নির্বাচন প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা কোনো নির্বাচন নয়; নিজেদের মধ্যে প্রীতিম্যাচ হয়েছে। প্রীতিম্যাচেও ধাক্কাধাক্কি হয়। ইনজুরড হয়। এটা তেমনও একটা ম্যাচ ছিল না। এই নির্বাচনে নির্বাচনের কোনো ক্যারেক্টারই ছিল না। যেখানে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় হওয়ার মতো প্রার্থী ছিল সেখানেও ডামি প্রার্থী বানানো হয়েছে, যারা মূল প্রার্থীদের নির্দেশনায় ভোটের মাঠে ছিল। তাদের ব্যানার-পোস্টারের টাকাও দিয়েছে এসব প্রার্থী। আবার দলীয় প্রার্থী স্বতন্ত্র নির্বাচন করলে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে যেখানে অ্যাকশন নেওয়ার কথা সেখানে উলটো তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যাতে নির্বাচন থেকে কোনো প্রার্থী সরে না দাঁড়ান। কিন্তু দিনশেষে দেখা যায়, সরকার যাকে পছন্দ করেছে তাকেই মেকানিজমের মাধ্যমে জিতিয়ে এনেছে। আর যাকে অপছন্দ হয়েছে তাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্বাচনকে কোনো অর্থেই প্রতিযোগিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা যাবে না। এটা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।’

চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘মীরসরাইয়ে কোনো নির্বাচন হয়নি। হয়েছে দখলবাজি। নৌকার প্রার্থী মাহবুবুর রহমান রুহেলের লোকজন প্রশাসনের সহযোগিতায় দখলবাজি করেছে। ভোটের দিন থেকেই নৌকার সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর এবং বাড়িঘরে হামলা শুরু করে । দুই দিনে আমার শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।’

তিনি জানান, ভোটের দিন ৬০-৭০টি কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয় সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। সকাল ৭টা থেকে সাড়ে সাতটায় যেসব এজেন্ট কেন্দ্রে গেছেন অনেক কেন্দ্রে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে নৌকার লোকজন ইচ্ছেমতো ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরেছে। ভোটের চিত্র দেখলেই বোঝা যায় সেটা। কোথাও তিনি ৫০-১০০ ভোট পেলেও নৌকার প্রার্থী ২-৩ হাজার ভোট পেয়েছেন। সিল মারার অনেক রেকর্ড আছে। এটাই ছিল মীরসরাইয়ে নির্বাচনের চিত্র। গিয়াস উদ্দিন বলেন, সরকারের তরফ থেকে সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস পেয়েই নির্বাচনে নেমেছিলাম। ভেবেছিলেন সুষ্ঠু ভোট হবে। আর সুষ্ঠু ভোট হলে জিতব এমন আত্মবিশ্বাস ছিল আমার। আগে যদি বলা হতো সরকারের পছন্দের প্রার্থীকে জেতানো হবে তবে নির্বাচনের মাঠে নামতাম না।

ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে মোমবাতি প্রতীকের প্রার্থী এমএ মতিন বলেন, ‘সুষ্ঠু ভোট হলে পটিয়ায় আমিই জয়ী হতাম। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ভোটের আগের রাতেও সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দেয়। তাছাড়া বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধ, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদেই আমাদের দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩৯টি আসনে প্রার্থী দেয় সারা দেশে। অথচ সরকার কথা রাখেনি। পটিয়ায় দিনের বেলা কেন্দ্র দখল করে ফল উলটে দেওয়া হয়েছে। ৮৫টি কেন্দ্র দখল করে নৌকার অনুসারীরা সিল মেরে ভোট নিয়ে নিয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, হাটহাজারী থেকে চকরিয়ায় গিয়ে ‘বিপুল ভোটে’ কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) ইব্রাহিম কীভাবে জয়ী হলেন? যার একজন কর্মীও চকরিয়ায় নেই। অথচ ইসলামী ফ্রন্টের লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক পটিয়াসহ সারা দেশে রয়েছে। সরকার এভাবে নির্বাচন করবে জানলে ইসলামী ফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নিত না।

এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সামশুল হক চৌধুরী অভিযোগ করেন, ভোট কারচুপি, জালিয়াতি, দখলবাজি করে নৌকার প্রার্থী ভোট ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং তাকে সুকৌশলে হারানো হয়েছে। তবে ভোট ছিনিয়ে নিলেও পটিয়ার সাধারণ মানুষ ও ভোটারদের অন্তর থেকে তাকে ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। এই আসনে সামশুল হক চৌধুরী তিনবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন ও হুইপ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। নৌকার প্রার্থী হিসাবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী এই আসনে জয়লাভ করেন।

চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুচ ছালাম (কেটলি) কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই জয়ী হয়েছেন বলে জানান তার প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট সৈয়দ নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখানেও কেটলিকে হারাতে শহরের অংশে দিনভর ব্যাপক বোমাবাজি, কেন্দ্র ভাঙচুর ও পুলিশের সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে। গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, গুলি চালানো হয়েছে। এটাকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট বলা না গেলেও কঠিন চ্যালেঞ্জ করেই কেটলি জিতেছে।

এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠকে সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নোমান আল মাহমুদের নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেউ সোলায়মান শেঠের পাশে ছিলেন না। বরং আওয়ামী লীগের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুচ ছালাম নির্বাচিত হন। সোলায়মান শেঠ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিঠি দিয়ে আমার সমর্থনে নৌকা প্রত্যাহার করে আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। এজন্য তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু মাঠে যারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, আমাকে হারানোর জন্য সব রকম কৌশল অবলম্বন করেছেন; প্রকারান্তরে তারা প্রধানমন্ত্রীকেই অপমান করেছেন।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button