সেলফি, হেডফোন, গল্প যখন কেড়ে নেয় প্রাণ: রেললাইনের নয়, দায় অসতর্কতার

মাসুম মিয়া (২১) ও ইতি খাতুন (১৯)। নবদম্পতি। পেশায় গার্মেন্টস কর্মী। একজনের বাড়ি নেত্রকোনায়। অন্যজনের ময়মনসিংহে। তাদের বিয়ে হয়েছিল গত ১৭ এপ্রিল। তারা গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। উঠেছিলেন টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর এলাকায় ভাড়া বাসায়। গত ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় উত্তরা ৮ নম্বর রেল গেট ও কোটবাড়ির মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় রেললাইনে তুলছিলেন সেলফি। আর এ সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যমুনা এক্সপ্রেসে কাটা পড়ে এ দম্পতির মৃত্যু হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পথচারীরা জানিয়েছেন, তারা দুই জন হাতে হাত ধরে রেললাইনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে সেলফি তুলছিলেন। সে সময় একটি ট্রেন কমলাপুরগামী ছিল, কিন্তু সে মুহূর্তে টঙ্গীগামী আরেকটি ট্রেন আসছিল। তারা সেটি খেয়াল করেত পারেনি। টঙ্গীগামী ঐ ট্রেনের ধাক্কায় মুহূর্তেই তারা ছিটকে পড়েন। মেয়েটি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তার স্বামীকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল ও পরে রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সর্বশেষ গতকাল বুধবার বিকালে রাজধানীর মগবাজারে পেয়ারাবাগ রেলগেট এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মো. আমির হোসেন (৫০) নামের এক ব্যক্তির দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ঢাকা মেডিক্যালে তাকে নিয়ে যাওয়া পথচারী মো. পলাশ জানান, মগবাজার পেয়ারাবাগ রেলগেট এলাকায় ট্রেন থেকে পা পিছলে নিচে পড়ে আমির হোসেন ট্রেনের চাকার নিচে চলে যান। এতে তার দুই পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়।
শুধু নবদম্পতির মর্মান্তিক মৃত্যু বা আমির হোসেনের দুই পা হারানোর ঘটনা প্রায়ই ঘটছে অসতর্কতার কারণে। ঢাকা রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জয়নাল আবেদীন জানিয়েছেন, তারা থানায় প্রতি মাসে এমন ২৫ থেকে ৩০টি ঘটনা ডায়েরিভুক্ত করা হয়। তিনি বলেন, রেল স্টেশন, রেললাইনসংলগ্ন এলাকার মসজিদ ও স্কুলে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয়। তবে জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে।
রেলওয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, চলন্ত ট্রেনে উঠানামা, ছাদে ভ্রমণ, দুই বগির সংযোগস্থল বাফারে বসা, ট্রেনের দরজার হাতলে ঝুলে যাতায়াত, রেললাইনের পাশ দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে হাঁটা, রেললাইনে বসে থাকা, অসতর্কভাবে রেললাইন পার হওয়া, অনেকেই আবার কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে, মোবাইলে কথা বলা অবস্থায় এবং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়েও ট্রেনে কাটা পড়ছে।
ট্রেনে কাটা পড়ে বছরে ১ হাজারের বেশি মৃত্যু :রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু ঘটনায় মোট মামলা হয় ৯৯৮টি। মোট লাশ উদ্ধার করা হয় ১ হাজার ১৭ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৭৯৪ এবং নারী ২২৩ জন। কানে ইয়ারফোন থাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় ৭৬ জনের। ট্রেন লাইনের ওপর বসে গল্প ও চলাচলের কারণে মৃত্যু হয় ৫০৪ জনের। অসতর্কভাবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টার সময় মৃত্যু হয় ২৭২ জনের। ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় ২৩ জনের এবং অপমৃত্যু হয় (মৃত্যুর সঠিক কারণ অজানা) ১৪২ জনের। ২০২৩ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় মোট মামলা হয় ১ হাজার ৫৪টি। মোট লাশ উদ্ধার করা হয় ১ হাজার ৬৪ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৮২৬ এবং নারী ২৩৮ জন। কানে ইয়ারফোন থাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় ১৮ জনের। রেললাইনের ওপর বসে গল্প ও চলাচলের কারণে মৃত্যু হয় ৫০২ জনের। অসতর্কভাবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টার সময় মৃত্যু হয় ৩৮৭ জনের। ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু ২৩ এবং অপমৃত্যু হয় (মৃত্যুর সঠিক কারণ অজানা) ১৩৪ জনের।
রেল পুলিশের তথ্যমতে, ঢাকা জোনের রেলওয়ে থানার অধীনে পাঁচটি ফাঁড়ি এলাকা থেকে গত চার বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে ১ হাজার ৮০১ জনের মৃত্যু হয়। এই ফাঁড়ি এলাকাগুলো হলো টাঙ্গাইল, টঙ্গী, জয়দেবপুর, এয়ারপোর্ট ও নারায়ণগঞ্জ।
বাংলাদেশ রেলওয়ে আইন :রেলের প্রচলিত আইনে রেললাইন ধরে হাঁটা অবৈধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। শুধু লাইন নয়, লাইনের দুই পাশে (১০ ফুট করে) ১৪৪ ধারা জারি থাকে সব সময়। বাংলাদেশ রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, এই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে তাকে আইনের ১০১ ধারায় গ্রেফতার করা যায়। এমনকি এই সীমানার ভেতরে গবাদি পশু চরলে আটক করে তা বিক্রি করে সেই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার বিধানও রয়েছে। কিন্তু এ আইন প্রতিনিয়তই ভঙ্গ করছেন পথচারীরা। তাই প্রতিনিয়তই ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।