Bangladesh

সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কের ঝড়: কিংস পার্টি নাকি আ.লীগ পুনর্বাসন কেন্দ্র!

গুনীজনদের কথা ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না’। সারমর্ম হচ্ছে, ইতিহাস কখনো হুবহু একইভাবে ফিরে আসে না। তবে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ইতিহাসের পুনঃমঞ্চায়ন হতে পারে। এখন সেটা কী আমরা দেখতে যাচ্ছি? ’৭১ এ বিজয় অর্জনের পর নতুন বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) গঠন করা হয়েছিল। সেই বিএলএফ থেকে জাসদ, ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগ-গণবাহিনী-রক্ষিবাহিনী গঠনের বিশৃংখল পরিণতি সবার জানা। ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে গত ৯ সেপ্টেম্বর বিএলএফের মতোই জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়। অর্ধশত বছর আগে মুজিবীয় শাসনামলে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের বিএলএফের বিরুদ্ধে যে প্রশাসনে আমলাদের উপর খবরদারি, নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল; একই অভিযোগ উঠেছে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে। ওই সময় বিএলএফের নেতাদের চাপে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় য্বুলীগ গঠন করা হয়েছিল। সংগঠনটির নেতা শেখ ফজলুল হক মনি বলেছিলেন, ‘আমরা দেশে আইনের শাসন চাই না, বঙ্গবন্ধুর শাসন চাই’। আইনের শাসনের বদলে মুজিবের শাসন কায়েম বিএলএফের কর্মকাণ্ডের পরিণতি আজ ইতিহাস। এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। এখনই জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সরকারের অংশ না হয়েও যেখানে বিরোধ সেখানেই ছুড়ে যান ছাত্রনেতারা সংকটের সুরাহার চেষ্টা করেন। সরাকরের আগেপিছে লেপ্টে থাকা ছাত্রনেতারা আবার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কিংস পার্টি গঠনের উদ্যোগ নিযেছেন। শুধু তাই নয় রাজনৈতিক দল গঠনের আগেই বাংলাদেশ সিটি ও পৌর কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশনের সভায় আওয়ামী লীগের মনোনীত কাউন্সিলরদের সহায়তা চেয়েছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে বিতর্কের ঝড়। রাজনীতিকদের অনেকেই ইতোমধ্যেই জাতীয় নাগরিক কমিটি ও সম্ভাব্য কিংস পার্টির নেতাদের রিরুদ্ধে ফ্যাসিন্ট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বসানের চেস্টার অভিযোগ তুলেছেন। প্রখ্যাত দার্শনিক প্রফেসর ড. সলিমুল্লাহ বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ আর রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারবে না। তাদের পরিণতি হবে মুসলিম লীগের মতো। যদি তারা নিজেরা ফিরতে পারে তাহলে আমাদের সব জ্ঞানার্জন বৃর্থা যাবে। তবে কেউ তাদের রাজনীতি ফেরাতে চাইলে অন্য কথা।’ প্রশ্ন হচ্ছে সত্যিই কী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভিন্ন নামের রাজনৈতিক দলে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে? তা নাহলে সংস্কারের নামে নির্বাচন ইস্যুতে সময়ক্ষেপণের কেন এই কূটচাল? প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিছু সংস্কার করে নির্বাচন দেয়ার পক্ষ্যে অবস্থান নিলেও উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে ভোটের লাটাই টেনে ধরার চেষ্টা হচ্ছে?

বাংলাদেশ সিটি ও পৌর কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন রয়েছে। শেখ হাসিনা মনোনীত ব্যক্তিরা ভোট ছাড়াই মূলত এই কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাদের আয়োজিত সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে যে নতুন রাজনৈতিক দল আসছে, সেই দলে আমরা আপনাদের (আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর) সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। নতুন রাজনৈতিক দলে আপনাদের এই ত্যাগ-তিতিক্ষা আমরা মূল্যায়ন করব।’ জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যাঁরা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন, তারা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই থাকুক।’ প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে কতজন মেয়র, কাউন্সিল, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন? বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মেয়র ও কাউন্সিলর সবাই আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পাতানো ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। হাসিনার পাতানো ভোটে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের কিংস পার্টিতে অন্তর্ভক্তির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন কী যুক্তসংগত? আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে দেশে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে তার পুনরাবৃত্তি হতে দেয়া যাবে না। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নতুন দেশ পেয়েছি, সেখানে কেউ কেউ ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আঁতাত করেছে, তাদের ফিরিয়ে আনার কথা বলছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে আওয়ামী লীগ দেশকে ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। আওয়ামী লীগের প্রশ্নে আমরা সবাই যেন এক থাকতে পারি সে লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের প্রশ্নে কোনো আপস চলবে না।’

অন্তর্বর্তী সরকারের উপর যারা প্রভাব বিস্তার করছেন সেই জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন প্রতিশ্রুতির বক্তব্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে বিতর্কের ঝড় উঠে। নেটিজেনরা এ নিয়ে নানান মন্তব্য-বক্তব্য দিচ্ছেন। বেশির ভাগ নেটিজেন মুজিব শাসনামলের বিএলএফের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটির তুলনা করছেন। তারা বলছেন, ‘৫ আগষ্টের সূর্য্য সন্তানদের কাছে জাতি আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন প্রত্যাশা করে না।’ কেউ কেউ লিখেছেন ‘ছাত্র নেতারা ইতোমধ্যেই বিতর্কিত হয়ে উঠেছেন। তারা আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের চেষ্টায় নতুন কিংস পার্টি গঠন করতে যাচ্ছেন।’ কেউ লিখেছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত দিল্লির তাবেদার একাধিক গণমাধ্যমের চেতনায় উজ্জীতি হয়ে কিংস পার্টি গঠনের চেষ্টা চলছে। এরাই ভারতের প্রেসক্রিপশনে বিএনপিকে ঠেকাতে সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বের কথা বলছেন। যাতে কিংস পার্টির ব্যানারে আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসন করা যায়।’ একজন লিখেছেন, ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী সাপের মতো আওয়ামী খোলস পাল্টিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে মিশে গেছেন। কিংস পার্টি গঠিত হলে যুবলীগ-মহিলা লীগ ও আওয়ামী লীগেরা তৃর্ণমূল পর্যায়ের নেতারা পুনর্বাসিত হবে’। সোস্যাল মিডিয়ায় বেশির ভাগই লিখেছেন, জেলা উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কিংস পার্টি গঠনের উদ্যোগ চলছে।’

সোস্যাল মিডিয়ার এই বিতর্কে বিএনপি নেতা (ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র প্রার্থী ছিলেন) ইশরাক হোসেন লিখেছেন, ‘খুনি হাসিনার ফিল্ড কমান্ডার ও জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের পুনর্বহালের দাবি জানানো শহীদদের রক্তের সঙ্গে সরাসরি বেইমানি করা। যারা খুনিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তাদের কেউ কেউ এখন কাউন্সিলর পুনর্বাসন চাচ্ছে! এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার আগে আমাকে লাশ বানিয়ে তার ওপর দিয়ে যেতে হবে।’ হাবিবুর রহমান আইনজীবী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কাউন্সিলররা জনপ্রতিনিধি, যেমন জনপ্রতিনিধি ছিল হাসিনা। গত দেড় দশকে দেশে নির্বাচন বলে কিছু ছিল না। আওয়ামী লীগের লোকজন ভোট ডাকাতি করে সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় কাউন্সিলর হয়েছে।’ তিনি ব্যঙ্গ করে লেখেন, ‘চমৎকার নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য রিফাত রশীদ লেখেন, ‘আওয়ামী আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনোকালেই জনগণের ম্যান্ডেট ছিল না। তাই বিএনপি বা জামায়াতের কাউন্সিলরদের ম্যান্ডেটও বৈধ হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। আওয়ামী আমলের নির্বাচনের বৈধতাদান হবে গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্খার বিপরীত।’ নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য মাহিন সরকার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মানেটা হলো কাউন্সিলর বহাল থাকবে!…কিতার মধ্যে শ্রম ঢালতেছি।’

অবশ্য বিতর্কের ঝড় থামাতে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা আওয়ামী আমলের নির্বাচনের কারও পুনর্বাসন চাই না। সারা দেশে পাঁচ হাজার কাউন্সিলরের মধ্যে এমন হাজারখানেক আছেন, যাঁরা আওয়ামী লীগের নন, স্বতন্ত্র। আমাদের আহ্বানটা তাঁদের প্রতি, যাঁরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের পক্ষে আন্দোলনে ছিলেন।’ প্রশ্ন হচ্ছে আওয়ামী লীগ রেজিমে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া এমপি, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, কাউন্সিলরদের মধ্যে কেউ কি আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে? মূলত ওরা সকলেনই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং অনেকেই পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের মতোই গুন্ডাপান্ডা নিযে অস্ত্র হতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছুঁড়েছেন।

সংস্কারের অজুহাতে নির্বাচন পেছানোর চেস্টা, সম্ভাব্য কিংস পার্টির নেতাদের আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের আগাম বার্তা, একাধিক উপদেস্টার মতলবী কথাবার্তা, এজন উপদেষ্টার কান্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র এখনো থেমে যায়নি, দেশের কোথাও একটা ষড়যন্ত্র চলছে। তাই জনগণকে সচেতন করতে হবে। জনগণকে সঙ্গে রাখতে হবে, থাকতে হবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor