স্বতন্ত্র রেখেই শরিকদের ৭ আসন
১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর জন্য সাতটি আসন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জোটের নেতৃত্বে থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জাতীয় পার্টি (জেপি) এ তিনটি দলকে এসব আসন ছাড়া হচ্ছে। এ আসনগুলোতে শরিকরা নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হলেও আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করছে না। জোটসঙ্গী তরিকত ফেডারেশনকে এবার আসন দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ ও জোটের শরিক দলের নেতারা এ কথা জানিয়েছেন।
তবে শরিকদের আসন কমানোর যে সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ নিয়েছে, তা ‘প্রত্যাখ্যান’ করার কথা জানিয়েছেন ১৪ দলের শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু।
তিনি বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে এটা অনানুষ্ঠানিক প্রাথমিক প্রস্তাব, চূড়ান্ত নয়। আমরা এটা গ্রহণ করিনি। আমরা আসন বাড়াতে বলেছি। ছাড় দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা যেন স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকেন, সেটিও নিশ্চিত করতে বলেছি। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসার দাবি জানিয়েছি।’
আসন সমঝোতার জন্য শরিক দলগুলোর নেতারা গত ৪ ডিসেম্বর থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেন। ওইদিন শরিক দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় জোটের সমন্বয়ক আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুকে। এরপর দফায় দফায় বৈঠকের পর সমঝোতায় আসা সম্ভব হয়েছে। তবে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কৌশলের জালে আটকে থেকেই শরিকদের আসন সমঝোতায় আসতে হয়েছে।
জোটের শরিক দলের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, তরিকত ফেডারেশনকে এবার কোনো আসন দেওয়া হয়নি। তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভা-ারীর ভাতিজা বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) প্রধান শাহজাদা সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদকে দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম-২ আসন। এ আসনে এখন সংসদ সদস্য নজিবুল বশর।
এ বিষয়ে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে সাতটি আসনে সমঝোতা হয়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ) তিনটি আসন দেওয়া হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টিকেও তিনটি। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টিকে (জেপি) দেওয়া হয়েছে একটি আসন।
জানা গেছে, বরিশাল-৩ আসনে রাশেদ খান মেনন, রাজশাহী-২ আসনে ফজলে হোসেন বাদশা ও সাতক্ষীরা-১ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর পরিবর্তে মুস্তফা লুৎফুল্লাহ নৌকা প্রতীকে ভোট করবেন।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর আসন কুষ্টিয়া-২ আগে থেকেই ফাঁকা রেখেছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া বগুড়া-৪ আসনে এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন ও লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে মোশাররফ হোসেন নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন। পিরোজপুর-২ আসন জোটের আরেক শরিক জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শরিক দলগুলোকে ১৩টি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ১১টি আসনে শরিকরা আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে। জেপির দুই প্রার্থী নিজেদের প্রতীকে ভোট করেন। এসব আসনের মধ্যে আটটি আসনের মধ্যে আটটিতে জয় পায়।
২০০৮ সাল থেকেই ১৪ দল ও আওয়ামী লীগ জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে আসছে। তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দুটিতে জোটের শরিক হিসেবে ছিল জাতীয় পার্টিও। তবে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের পর জাতীয় পার্টি জোটে ছিল না। এবারও বিএনপি ভোটে আসেনি, জাতীয় পার্টিকেও জোটে রাখা হয়নি।
গত নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি আসন পায় ওয়ার্কার্স পার্টি। আসনগুলো ছিল ঢাকা-৮, রাজশাহী-২, বরিশাল-৩, ঠাকুরগাঁও-৩ ও সাতক্ষীরা-১। এর মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী ও সাতক্ষীরায় জয় পায় দলটি। জাসদ পায় তিনটি আসন। এগুলো হলো কুষ্টিয়া-২, ফেনী-১ ও বগুড়া-৪। কুষ্টিয়া ও ফেনীতে দলটির দুই প্রার্থী জয় পান।
তরিকত ফেডারেশন পায় লক্ষ্মীপুর-১ ও চট্টগ্রাম-২ আসন। দলটির প্রার্থী জয় পান চট্টগ্রামে।
জেপি পায় কুড়িগ্রাম-৪ ও পিরোজপুর-২ আসন; এর মধ্যে জয় পায় পিরোজপুরে।
বাংলাদেশ জাসদ পায় চট্টগ্রাম-৮ আসন। সেই আসনে বিজয়ী প্রার্থী মইন উদ্দীন খান বাদল ২০২০ সালে মারা গেলে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতা মোসলেম উদ্দিন আহমেদ বিজয়ী হন। তিনি ২০২৩ সালে মারা যান। গত ২৭ এপ্রিল আবার উপনির্বাচন হলে জয় পান আওয়ামী লীগের নোমান আল মাহমুদ।
এর আগে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, ১৪ দলীয় জোটের দৌড়ঝাঁপের মূলে রয়েছে তাদের দলের প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী তুলে দেওয়া। মূলত জয়ের নিশ্চয়তা চেয়ে আসছে তারা আওয়ামী লীগের কাছে। এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের প্রধান নেতা শেখ হাসিনা জোটের প্রার্থীদের জয়ের নিশ্চয়তা দিতে রাজি নন। নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন করার বিধিনিষেধ তুলে দিয়েছেন তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসুক সবাই।
বিদেশি চাপ ও বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেকোনো মূল্যে জমিয়ে তুলতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিও স্বাভাবিক পর্যায়ে ঘটুক এটাই চান তিনি। তাই এবার শরিক দলগুলো নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করুক সেটা চাননি জোটের প্রধান নেতা, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আবার শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা তা মানছিলেন না। আসন সমঝোতায় শেখ হাসিনার রাজি হওয়ার কারণ, নিবন্ধিত দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করলে বেশি দলের অংশগ্রহণ দেখানোর যে কৌশল তাতে দুর্বলতা খুঁজে পাবে বিদেশিরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা নানা দিক তুলে ধরে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। ওই নেতারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ আসন না ছাড়লে অর্থাৎ নৌকা প্রতীকে ভোট করতে না পারলে জয় নিশ্চিত নয়। জয় না পেলে নিজেদের দল বিপন্ন হবে।
জোটের এক নেতা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ সভায় জোটের নেতারা বর্তমান সংসদে যারা রয়েছেন, তারা যাতে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে পারেন সেই সুযোগ চেয়েছেন।
জোটের এ নেতা আরও বলেন, শেষমেশ বর্তমান সংসদে থাকা চার সংসদ সদস্য বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভা-ারীকে আসন ছাড়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের চিন্তাভাবনা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সব দিক বিবেচনা করে তাদের সাত আসনে ছাড় দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভা-ারী বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থাশীল। এখনো দুদিন সময় আছে, দেখা যাক।’