স্বা গ ত ২০২৫ নির্বাচন-সংস্কার দ্বৈরথের বছর
নানা ঘটনা, ঐতিহাসিক এক বিপ্লবের সাক্ষী হয়ে বিদায় নিয়েছে ২০২৪। কালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরও একটি বছর। শুরু হলো নতুন বছর ২০২৫। নতুন প্রত্যাশা, নতুন সম্ভাবনা সামনে রেখে যাত্রা শুরু হলো নতুন বছরের। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথ নেয়া হয়েছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই। নতুন বাংলাদেশ গড়ার এই যাত্রায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাড়ে চার মাস পার করেছে। এই সময়ে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি নিয়ে মানুষের মাঝে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে মুখিয়ে আছে পুরো দেশ। রাজনৈতিক দলগুলোও চাইছে সম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকার এগোচ্ছে একগুচ্ছ সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে। রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার কাঠামো, প্রশাসন, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি সব স্থানে বিশদ সংস্কার প্রয়োজন। জনমুখী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এই সংস্কার যেমন জরুরি তেমনি প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর ছাত্র-জনতা সংস্কারের দাবিকেই সামনে এনেছিলেন। এরসঙ্গে এখন নির্বাচনের দাবি সামনে এসেছে নানা কারণে। নতুন বছরে নতুন সরকারের সামনে নির্বাচন আর সংস্কারের দ্বৈরথ পরিস্থিতি। সরকারের তরফ থেকে এ বছরই নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে এক ধরনের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। যদিও সময়সীমা নিয়ে পরিষ্কার কোনো রোডম্যাপ জাতির সামনে হাজির করেনি সরকার। বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো চাইছে এ বছরের মধ্যেই যাতে নির্বাচন আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ ছাত্র নেতারা চাইছেন সংস্কার প্রক্রিয়া আগে শেষ করতে, তারপর নির্বাচন। এই দ্বিমুখী চাপে থাকা সরকারের সামনে আরও নানা ইস্যু হাজির হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রশাসনের অস্থিরতা কাটেনি। একের পর এক ষড়যন্ত্র। অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া শক্তির নানা অপপ্রচার আর অপকৌশল মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। নতুন বছরে এসবের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে বোঝাপড়ার বিষয়ে সরকারকে বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ ছাড়া দায়িত্ব নেয়ার পর নানা বিষয়ে সরকারের ব্যর্থতা সামনে আসছে। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। শক্তহাতে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। এ ছাড়া নানা খাতে বিদ্যমান অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা কাটাতে তেমন দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। উদ্যোগ থাকলেও দৃশ্যমান সফলতা দেখা যাচ্ছে না। আগের সরকারের লুটপাটের কারণে অর্থনীতিতে যে ঘা তৈরি হয়েছিল তা সারাতে কোনো দাওয়াই এখন পর্যন্ত তেমন কাজ করছে না।
এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের কাউকে কাউকে নিয়ে বিতর্কও সামনে আসছে। এসব কারণে বিপ্লব পরবর্তীতে মানুষের মাঝে যে বিপুল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তা দিনে দিনে ম্রিয়মান হয়ে আসছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষ আর বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র-জনতার বৈপরীত্য পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এমন অবস্থায় নতুন বছরে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে নানামুখী চ্যালেঞ্জে সময় পার করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজনৈতিক ঐক্যকেই গুরুত্ব দিচ্ছে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া দল ও ছাত্র সংগঠনগুলো। ইতিমধ্যে সরকারের তরফ থেকে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়েছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করার কথা জানিয়েছে সরকার।
ওদিকে সরকার পতনের পর স্বস্তি মিললেও নানা কারণে রাজনৈতিভাবে চাপে ছিল দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের মধ্যদিয়ে বিএনপি স্বাধীন পরিবেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ পায়।
সরকার পতনের পর ৬ই আগস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সাজা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পান। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো প্রত্যাহার হচ্ছে। দলটির নেতাকর্মীরা আগের চেয়ে এখন বেশি উজ্জীবিত। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে তারা নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করতে চান। তারেক রহমান নিজেও নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। নিজে বিরামহীন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন বছরে দলীয় কর্মকাণ্ড আরও বেগবান করতে চায় দলটি। সঙ্গে নির্বাচনী প্রস্তুতিও সারতে চাইছে দলের হাইকমান্ড।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরু থেকেই এই সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে বিএনপি। তবে সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করে নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিও জানাচ্ছে তারা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নতুন বছরেও তারা এই দাবি নিয়ে আরও বেশি সোচ্চার হবে। পাশাপাশি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবে দলটি।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান মানবজমিনকে বলেন, নতুন বছর সুন্দর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের মূল প্রত্যাশা। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে সরকার গঠিত হবে বলেও আমাদের প্রত্যাশা। জনগণ ফিরে পাবে তাদের ভোটাধিকার। আমরা নতুন বছরে এই প্রত্যাশা করি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল মানবজমিনকে বলেন, নতুন বছরে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। এই ঐক্য করার জন্য আমরা নতুন বছরের শুরু থেকেই চেষ্টা করবো। রাজনৈতিক ঐক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সকলকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ২৫ সাল হবে নব দিগন্ত সূচনার বছর। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব দেবে। ২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে নতুন বছরে আমরা মনোনিবেশ করবো।
ওদিকে জুলাই বিপ্লবের আগে রাজনৈতিক চাপে ছিল জামায়াতে ইসলামী। অনেকটা গোপনে ছিল তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনে রাজনৈতিকভাবে সামনে চলে আসে দলটি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও দলটির নেতাকর্মীরা ব্যাপক তৎপর ছিলেন। আন্দোলনে দলটির অনেক নেতাকর্মী শহীদ ও আহত হয়েছেন। সরকার পতনের পর জনসম্পৃক্ততামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সারা দেশে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে দলটি। কর্মী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নিচ্ছে নির্বাচনের প্রস্তুতিও। নতুন বছরও সাংগঠনিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে দলটি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ মানবজমিনকে বলেন, ২০২৪ সাল হচ্ছে স্বৈরাচার থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার বছর। ২৫ সাল হবে ভবিষ্যৎ ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত করার বছর। এই বছরে জামায়াত জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ে গণজোয়ার তৈরি করবে। যার মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
এদিকে ৫ই আগস্টের পর থেকে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে যুগপৎ আন্দোলনের জোট ও দলগুলো। নতুন বছরেও তারা নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকবে। নতুন বছরে তারা রাজনৈতিক গণঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। ওদিকে ইসলামী দলগুলোও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে। ইসলামী দলগুলো একটি নির্বাচনী জোটও করার চেষ্টা করছে। তবে এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে।
মাঠে তৎপর আছে বিএনপি’র সমমনা দল ও তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোও।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, নতুন বছরে প্রত্যাশা করি, দেশ গণতন্ত্রের অভিযাত্রার দিকে হাঁটবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যদিয়ে জনপ্রতিনিধিদের একটা সংসদ হবে, এটা হবে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে দ্বিতীয় পর্যায়ের সফলতা। নতুন বছরে বৈষম্য বিলোপের ব্যাপারে ধারাবাহিক কর্মসূচি নেয়া হবে। আর গণঐক্য নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে নতুন বছরে ঐক্যকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, নতুন বছরে গণতন্ত্র উত্তরণের নির্বাচনই প্রধান লক্ষ্য হবে। এজন্য আমরা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি। আর ‘সবার আগে বাংলাদেশ’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে নতুন বছরে আমরা ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে চাই।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, নতুন বছরে প্রধান প্রস্তুতি থাকবে নির্বাচন। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী নতুন বছরের শেষদিকে কিংবা ২৬ সালের প্রথমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এজন্য মূল প্রস্তুতি থাকবে নির্বাচন। আর বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। যার দায়িত্বে থাকবে নির্বাচন কমিশন। আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের সহযোগিতা করবো।
ওদিকে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এ প্ল্যাটফরমের নেতাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই এই দলের আত্মপ্রকাশ হতে পারে। নতুন বছরে রাজনীতির মাঠে নতুন এই দলের আবির্ভাব বদলে দিতে পারে পরিস্থিতি। তবে অনেকে বলছেন, অতীতের মতো কিংস পার্টির রূপে নতুন দল এলে তা রাজনীতির মাঠে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। যদি মানুষের চাওয়া অনুযায়ী নতুন ধারা তৈরি করতে পারে তাহলে নতুন দল রাজনীতির জন্য আশীর্বাদ হতে পারে।
Regards for all your efforts that you have put in this. very interesting information.