স্বেচ্ছায় অপরাধ করে কারাগারে যান জাপানের বৃদ্ধরা
জাপানে একাকী বসবাসকারী প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ৫টি পরিবারের একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে, অর্থাৎ ১ কোটি ১০ লাখ মানুষকে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে। বিষয়টি সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর বিপুল চাপ তৈরি করবে। জাপানের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিটি রিসার্চের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে একটু আরাম-আয়েশ তো দূরের কথা, উল্টো জাপানের অধিকাংশ প্রবীণ লোক যে কত অসহায় হয়ে পড়বে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সরকারস্বীকৃত গবেষণা সংস্থাটির ওই প্রতিবেদন। কীভাবে বিপুলসংখ্যক প্রবীণ লোককে সেবা দেওয়া যায় তার উপায় খুঁজছে জাপান সরকার।
প্রতি ৫ বছরে এ ধরনের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাপানের সংস্থাটি। গত ১২ এপ্রিল প্রকাশিত সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে দেশটিতে ৭৩ লাখ ৭০ হাজার বয়স্ক মানুষ একা বসবাস করতেন, যা মোট পরিবারের ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। ২০৫০ সালে একক-ব্যক্তি পরিবারের সংখ্যা ২৩ দশমিক ৩ মিলিয়নে পৌঁছাবে, যা মোট পরিবারের ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
তরুণ-তরুণীদের দেরিতে বিয়ে করা এবং সন্তান না নেওয়ার প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণেই এমন সংকট তৈরি হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
টোকিও শহরের সেভেন ইলেভেন নামের একটি সুপার শপে কথা হয় শিগেও নামের ৭৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি জানান, তার স্ত্রী অসুস্থ হওয়ায় তেমন একটা চলাফেরা করতে পারেন না। তাই এ বয়সেও স্ত্রীকে দেখাশোনার পাশাপাশি নিজের কাজও করতে হয় তাকে। একমাত্র কন্যাসন্তান বিয়ে করে অন্যত্র থাকে। মাঝেমধ্যে মেয়ে এসে তাকে খাবার তৈরি ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে দিয়ে যায়। এভাবে কত দিন চলা সম্ভব হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি।
জাপানি নাগরিকদের বয়স ৬৫ বছর হলেই তাকে প্রবীণ গণ্য করা হয়। ওই বয়সে সরকারিভাবে একজন নাগরিক অবসরে যান এবং পেনশন পেতে শুরু করেন। সে দেশে এমন বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ (প্রায় পৌনে ৪ কোটি) বলে উল্লেখ করা হয়েছে জাপানের স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে।
বিশে^র সর্বোচ্চ আয়ুর দেশগুলোর অন্যতম জাপানে প্রবীণ জনগোষ্ঠী রয়েছে অনেক। গত শতকের আটের দশকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠার পর পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির এ দেশটিতে জনসংখ্যা কমছে ক্রমেই। জনসংখ্যার ভারসাম্য ঠিক রাখতে জাপান সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না।
জাপানের জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি মানুষের বয়স ৮০ বছর বা তার বেশি। জন্মহার কমে যাওয়া ও প্রবীণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের পেনশন, চিকিৎসাসেবা প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে গিয়ে জাপান সরকারের ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। প্রবীণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শ্রমের ঘাটতিও দেখা দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, টোকিওর এক-তৃতীয়াংশ পুরুষ ৫০ বছর বয়সেও বিয়ে করেননি। দেশটির মানবসম্পদ প্রতিষ্ঠান রিক্রুট হোল্ডিংয়ের তথ্য বলছে, জাপানের ৪৬ শতাংশ পুরুষ ও ৩০ শতাংশ নারী ২০ বছর বয়সের আগ পর্যন্ত কখনো ডেট করেননি।
এখনো অধিকাংশ বয়স্ক ব্যক্তির সন্তান ও ভাইবোন থাকায় তাদের দেখাশোনা করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু ৩০ বছর পর সন্তানহীন বয়স্ক একক ব্যক্তির পরিবারের অনুপাত কমে যাওয়ার পাশাপাশি স্বজনদের সংখ্যাও কমার আশঙ্কা করা হয়েছে ওই গবেষণা প্রতিবেদনে।
জাপানে প্রতি বছর ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ মানুষ কমছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে এই সংখ্যা প্রায় ১০ লাখে দাঁড়াবে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।
গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত সরকারি তথ্যমতে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত জাপানের জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখ কমে ১২ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়িয়েছে।
জনসংখ্যা কমাসহ নানা কারণে জাপানের বিভিন্ন শহরের অনেক সুপার শপ বা দৈনন্দিন বাজার করার দোকান একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন সে দেশের প্রবীণ বাসিন্দারা। তাদের প্রতিদিনের খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
জাপানের কৃষি, বন ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৮২ লাখের বেশি বয়স্ক মানুষের কেনাকাটার জন্য যাতায়াতে অসুবিধা হচ্ছে।
দোকানপাট বন্ধ হতে থাকায় বিভিন্ন এলাকায় ট্রাকে করে খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ভ্রাম্যমাণ দোকান পরিচালনার উদ্যোগ নিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা। পাশাপাশি কয়েকজন মিলে নিজেদের প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক সুপার শপ চালু করতে বিনিয়োগ করছে মানুষ। নানা সংকটের কারণে তাও ঠিকমতো হচ্ছে না। অবসরে যাওয়ার পরও অনেকে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রতিদিন শতাধিক মানুষ চাকরির খোঁজ করেন।
স্বেচ্ছায় কারাগারে যেতে চান নিঃসঙ্গ মানুষেরা: নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে এবং দৈনন্দিন ব্যয় সামলাতে না পেরে বৃদ্ধদের অনেকেই স্বেচ্ছায় কারাবাস করেন। এ জন্য তারা ইচ্ছে করেই নানা অপরাধে জড়ান। অনেকে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে কিছুদিন পর আবার কারাগারে যেতে একাধিকবার অপরাধ করেছেন বলে জাপানের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে। সাধারণত তারা বড় অপরাধ করেন না। রাস্তার পাশ থেকে বাইসাইকেল চুরি কিংবা দোকান থেকে ছোটখাটো পণ্য চুরি করে পুলিশের হাতে ধরা দেন। আবার কেউ ছুরি উঁচিয়ে লোকজনকে ভয় দেখিয়েও কারাগারে যান। অবশ্য কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে তারা ছুরি দেখান না। বিনা খরচে থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি নিঃসঙ্গতা কাটাতেই তারা কারাগারে যান।
জাপানিরা ভীষণভাবে আইন মেনে চললেও কিছু মানুষ ছোটখাটো অপরাধ করেন। তাদের মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যাই বেশি। ১৯৯৭ সালে প্রতি ২০ জনের একজন অপরাধী ছিলেন ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। এখন সে সংখ্যা চারজনের একজন।
অবসরপ্রাপ্ত অনেক বৃদ্ধ পেনশনের টাকা দিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে না পেরে ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন এমন তথ্যও বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। জাপানে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্প প্রভৃতি দুর্যোগে বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েন।
কিতা সিটির ইউতা সাতো নামের একজন জানালেন, চাকরির সুবাধে তিনি টোকিওতে থাকেন। তার বাবার মৃত্যুর পর মা আলাদা থাকায় গ্রামে তার বৃদ্ধ দাদি একা থাকেন। সপ্তাহে একবার গিয়ে তার দৈনন্দিন বাজার এবং ওষুধপত্র দিয়ে আসেন। দাদির অসুবিধা হচ্ছে কি না, সব সময় এমন দুশ্চিন্তায় থাকেন তিনি। দাদিকে সময় দিতে গিয়ে ছুটির দিনে কোথাও ঘুরতে যাওয়া কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো হয় না তার।
জাপানের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এমনও ঘটনা আছে যে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা একা বাসায় থাকতে থাকতে একদিন তারা মারা যান। মরা পচা দুর্গন্ধ আশপাশে ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত তাদের খবর কেউ রাখে না। মরে-পচে কঙ্কাল হওয়ার পর কয়েক বছর পর বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধের সময় এ কথা জানা যায়। ব্যাংকে জমা অর্থ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব বিল পরিশোধ হয়ে যায়। কদাচিৎ বকেয়া বিল আদায়ের জন্য তার বাসায় খুঁজতে এসে দেখা যায় তিনি মরে কঙ্কাল।