হলফনামা শুধু কাগজেই
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীকে তার মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা জমা দিতে হয়। এতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সম্পদের বিবরণসহ আট ধরনের তথ্য দিতে হয় প্রার্থীকে। হলফনামায় ভুল বা অসত্য তথ্য থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে ইসি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হলফনামায় প্রার্থীরা যেসব তথ্য দেন তা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই হয় না। এ ছাড়া যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যে সময় দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট নয়। ফলে অনেক প্রার্থীর পক্ষে তথ্য গোপনের সুযোগ থেকে যায়। তাছাড়া কমিশনের পক্ষ থেকে যদি এসব তথ্য ভোটারদের মধ্যে সঠিকভাবে প্রচার করা হতো, তাহলে তারা জেনেবুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারতেন।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে প্রার্থীদের আয়-ব্যয়ের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে কখনই প্রার্থীদের তথ্য সঠিকভাবে সরবরাহ করা হয় না। আমরা বহুদিন থেকে বলে আসছি নির্বাচন কমিশনের হলফনামার তথ্যগুলো ধারাবাহিকভাবে যাচাই-বাছাই করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রার্থীরা হলফনামায় যে তথ্যগুলো দেয়, তা শতভাগ সঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা তথ্য গোপন করে। আবার অনেকে মিথ্যা তথ্য দেয়। কেউ আবার বিভ্রান্তিমূলক তথ্যও দিয়ে থাকে। এগুলোর কোনো নির্ভরযোগ্যতা নেই।’
বদিউল আলম বলেন, ‘এ তথ্য দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সচেতন করা, যাতে ভোটাররা জেনেশুনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এ উদ্দেশ্য তখনই ভুল হয়ে যায় যখন এ তথ্যর সঠিকতা না থাকে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, নির্বাচন কমিশন এ তথ্যগুলো প্রচার করবে যাতে মানুষের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু কোনো নির্বাচন কমিশন তা করেনি। ইসির উচিত ছিল এ তথ্যগুলো তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া। যাতে অন্যরাও যাচাই করার সুযোগ পায়। আসলে তারা স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে। যাতে মানুষ না জানতে পারে।’
গত ১৫ নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এই তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমদানের শেষ দিন ছিল ৩০ নভেম্বর। সবমিলিয়ে ২৯টি দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে ২ হাজার ৭১৬ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা পড়ে। যাচাই-বাছাই শেষে বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৮৫ জন। বাদ পড়া ৭৩১ জনের মধ্যে ৪২৩ জনই স্বতন্ত্র। তাদের বেশিরভাগ বাদ পড়েছেন নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত সমর্থন তালিকায় গরমিল থাকার কারণে।
এ ছাড়া হলফনামায় অসত্য তথ্য দেওয়া, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ না দেওয়া, লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকা এবং মামলার তথ্য গোপনের অভিযোগ রয়েছে। দলীয় প্রার্থী বাদ পড়েছেন তিনশর বেশি। তাদের বেশিরভাগের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে ঋণ, বিল ও করখেলাপির কারণে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া তথ্য নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। হলফনামায় তারা সম্পদের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। বিশেষ করে যারা গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে সংসদ সদস্য হয়েছেন, তাদের কারও কারও সম্পদ কয়েকগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। আবার তাদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে ঋণখেলাপির অভিযোগও রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে এসব প্রার্থীর সিআইবি তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাচাই-বাছাইয়ে ১১৮ জন প্রার্থী ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। পরে এ তথ্য নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের সম্পদ ও ঋণ দুটিই বেড়েছে। গত ১০ বছরে দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকাকালে তার সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ। সঙ্গে বেড়েছে ঋণের পরিমাণও।
গত পাঁচ বছরে জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত মহাসচিব ও সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গার নগদ অর্থ বেড়েছে প্রায় ১৬ গুণ। একই সঙ্গে তার জমিসহ স্থাবর সম্পত্তিও বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো অর্থ জমা না থাকলেও এবার ১ কোটি ৬৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯৩ টাকা জমা দেখিয়েছেন তিনবারের এই সংসদ সদস্য।
সম্পদ ও আয় বেড়েছে রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার। তিনি ১৪ দল থেকে মনোনয়নপ্রাপ্ত বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা। গত তিনবারের চেয়ে এবার আয় ও সম্পদ দুটিই বেড়েছে এই সংসদ সদস্যের। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইসিতে দাখিল করা হলফনামায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
২০০৮ সালে ফজলে হোসেন বাদশার বার্ষিক আয় ছিল ৩ লাখ ২৮ হাজার ৯১ টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭ লাখ ৫০০ টাকায়। সর্বশেষ ২০২৩ সালে তার বার্ষিক আয় দাঁড়িয়েছে ৪৭ লাখ ৬৭ হাজার ১৯৭ টাকা।
একই অবস্থা ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যদের। গত ১০ বছরের ব্যবধানে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের নগদ টাকা বেড়েছে ২১৮ গুণ। ১০ বছর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি তার কাছে ৫ লাখ টাকা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেছেন, তার কাছে নগদ আছে ১০ কোটি ৯২ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৯ টাকা, যা ১০ বছর আগের তুলনায় ২১৮ গুণ বেশি। পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণও ১০ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২ কোটি ৫৪ লাখ ৬০ হাজার ৭৮৭ টাকা।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নিজে কোনো তথ্য যাচাই-বাছাই করে না। কেউ কোনো অভিযোগ করলে তা খতিয়ে দেখতে পারে।’