Bangladesh

হাউজবোটে হাওরে ভেসে জমজমাট পর্যটন

কাঠের তৈরি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত হাউসবোটগুলোয় সাধারত চার থেকে ছয়টি কক্ষ থাকে; বিশেষভাবে নকশা করা এসব জলযানে থাকে বিদ্যুতের ব্যবস্থা।

ওপরে নীল আকাশ, নিচে বিস্তৃত নীল জল; এর মাঝেই টাঙ্গুয়ার হাওরে ভেসে চলে পর্যটকবাহী হাউসবোট।

বর্ষাকালে দেশের পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য এখন সুনামগঞ্জের হাওর। বিশেষ করে মেঘালয়ের পাদদেশে তাহিরপুর, মধ্যনগর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার সাইট হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।

দুই দশক আগে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘিরে পর্যটন শুরু হলেও তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে গত কয়েক বছর ধরে। বিস্তৃত জলরাশির এই হাওরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য জলে ভাসানো হয়েছে শতাধিক দৃষ্টিনন্দন হাউসবোট।

স্থানীয় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বাইরের জেলার অনেকেই এখানে উদ্যোক্তা হয়েছেন। আধুনিক সুবিধা সম্বলিত হাউসবোট বানিয়ে হাওরের ভাসিয়েছেন তারা। বন্ধু কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় এই বাহনটি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

হাউজবোটে হাওরে ভেসে জমজমাট পর্যটন

জীববৈচিত্রের আধার এই হাওরে রয়েছে হিজল-করচের বড় বাগান। পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। যেখান থেকে হাওরের সৌন্দর্য দেখা যায় ‘পাখির চোখে’।

শীত ও বর্ষায় হাওরের সৌন্দর্য বদলে যায়। এই সৌন্দর্য দেখতে, নীল জলে শরীর ভেজাতে দীর্ঘদিন ধরেই হাওরে আসছেন পর্যটকরা। একটা বড় সময় পর্যন্ত দেশি পদ্ধতিতে তৈরি নৌকাতেই ঘুরে বেড়াতেন তারা। তবে গত তিন-চার বছর ধরে হাউসবোটগুলো ভ্রমণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

কাঠের তৈরি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত হাউসবোটগুলোয় সাধারত চার থেকে ছয়টি কক্ষ থাকে। বিশেষভাবে নকশা করা এসব জলযানে থাকে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। অন্দরসজ্জায় ব্যবহার করা হয় দৃষ্টিনন্দন সব সামগ্রী, থাকে উন্নত টয়লেট।

এসব সুবিধার কারণে আরামে ঘুরে বেড়াতে শৌখিন পর্যটকরা বেছে নেন হাউসবোট। তাই তাদের কথা বিবেচনা করে নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধার সমন্বয় ঘটাচ্ছেন হাউসবোটগুলোর উদ্যোক্তারা।

উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই বাইরের জেলার হলেও এসব হাউসবোটে যারা কাজ করেন, পর্যটকদের সেবা দেন তারা সবাই স্থানীয়। এসব বাহনে পর্যটকদের আপ্যায়নে ব্যবহৃত হয় স্থানীয় চাল, মাছ, সবজি, হাঁসের মাংস। ফলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও পড়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের পর্যটন বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব।

হাউজবোটে হাওরে ভেসে জমজমাট পর্যটন

তবে এসব হাউসবোট নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে। সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগ এবং নতুন ব্যবসায়িক মডেল হওয়ায় সরকারের রাজস্ব আদায়ের কোনো পদ্ধতি নেই। অর্থাৎ, শতাধিক আধুনিক ও ব্যয়বহুল হাউসবোটগুলো সরকারকে কোনো রাজস্ব দেয় না।

অন্যদিকে পরিবেশবিদরা ইকোট্যুরিজমের দাবি তুলেছেন। তারা বলছেন, হাওরে প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটলে, বর্জ্য ফেলায় কোনো নিয়ম-নীতি মেনে না চললে, শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে হাওরের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য পর্যটকবাহী নৌকা ও হাউসবোটে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়েছেন তারা।

টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে এসেছিলেন সিলেটের বেসরকারি লিডিং ইউনিভার্সিটির ছাত্রী রোকসানা আক্তার রূপা।

হাউজবোটে হাওরে ভেসে জমজমাট পর্যটন

তিনি বলেন, “টাঙ্গুয়ার হাওর, শিমুলবাগানে অনেকবার ঘুরেছি। তবে আগে হাউসবোট ছিল না। এখন পর্যটকরা সপরিবারে আনন্দের সঙ্গে ভ্রমণ করতে পারেন। তবে এগুলোর ভাড়া বেশি। তাছাড়া অনেক অসচেতন পর্যটক প্লাস্টিকের বর্জ্য হাওরে ফেলেন। এ বিষয়ে হাউসবোট সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকা উচিত।”

ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা শাহনাজ পারভিন অভিযোগ করলেন গাইডদের নিয়ে। তিনি বলেন, “গাইডদের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক উদাসীনতা ও অজ্ঞতা আছে। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকায় পর্যটনে যুক্ত থাকলে পরিবেশের বিষয়টি সবার আগে মাথায় রাখতে হবে।”

হাউসবোটগুলোর মান ভালো জানিয়ে তাহিরপুরের সাংবাদিক রাজন চন্দ বলেন, “এসব হাউসবোটের কারণে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘিরে বিপুল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এগুলোর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়ার অভিযোগও আছে। আবার সরকারকে কোনো রাজস্বও দিতে হয় না। তাই হাউসবোটগুলোকে রাজস্বের আওতায় এনে একটি গাইডলাইনের মাধ্যমে পরিচালনার ব্যবস্থা করা হলে পর্যটকরা সুরক্ষিত থাকবেন।”

হাওরের পর্যটনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অর্থনীতি বিকশিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রশাসনের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা।

হাউজবোটে হাওরে ভেসে জমজমাট পর্যটন

হাউসবোট ময়ূরাক্ষীর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আকরাম হোসেন বলেন, “এ বছর হাউসবোট ভ্রমণে ইচ্ছুক পর্যটকদের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি। তাদের চাহিদা পূরণে আমরাও নানা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের হাউসবোটগুলো আগের চেয়ে উন্নত করা হয়েছে। বোটগুলো এখন বেশ উঁচু, ভেতরে সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে।”

শ্রীপুর গ্রামের হাউসবোট পানসীর মালিক মাইজুদ্দিন জানালেন, সব মিলিয়ে হাওরে দেড় শতাধিক হাউসবোট রয়েছে। একটি হাউসবোট তৈরিতে ৫ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়। এই টাকা উঠে আসতে সময় লাগে। তবে দিন দিন যেভাবে পর্যটকদের আগ্রহ বাড়ছে, তাতে হাউসবোট ব্যবসার সুদিন আসছে।

রাজস্ব আদায় ও বোট পরিচালনার নীতিমালা সম্পর্কে জানতে চাইলে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা বলেন, “গত বছর প্রায় ১৩৫টি নৌকা/হাউসবোট রেজিস্ট্রেশন করেছিল। তবে এবার হাউসবোটের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসন উন্মুক্ত মতবিনিময় সভা করে একটি গাইডলাইন তৈরিসহ রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার বিষয়ে আলোচনা করেছে। হাওরে কীভাবে পর্যটকবাহী হাউসবোট পরিচালিত হবে সেই গাইডলাইন তৈরি করা হচ্ছে।”

তবে এই গাইডলাইনে পর্যটন খাতকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

হাউজবোটে হাওরে ভেসে জমজমাট পর্যটন

তবে ইকোটুরিজম ছাড়া হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতি বাঁচানো যাবে না বলে মন্তব্য করলেন তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল।

তিনি বলেন, “হাউসবোট বা হাওরে নৌযান পরিচালনার সুষ্ঠু নীতিমালা নেই। পর্যটকবাহী জলযান থেকে অবাধে প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এতে বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। এসব মাথায় রেখেই হাউসবোটের নিবন্ধন দিতে হবে।”

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মকসুদ চৌধুরী বলেন, “কিছুদিন আগে হাউসবোট নিয়ে যে মতবিনিময় সভা হয়েছে সেখানে নানা প্রস্তাব এসেছে। সেগুলো মাথায় রেখে এবং পর্যটনকে উৎসাহিত করতে প্রচলিত আইন কানুনের আলোকে একটি গাইডলাইন তৈরি করার কাজ চলছে।”

তবে রেজিস্ট্রেশন যেহেতু জটিল প্রক্রিয়া, তাই আরেকটু সময় নিয়ে তার পদ্ধতি চূড়ান্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button