Bangladesh

হাজির হচ্ছেন না দুদকে, ধরাছোঁয়ার বাইরে বেনজীর পরিবার!

৬ জুন বেনজীর ও ৯ জুন স্ত্রী-সন্তানের পক্ষে আইনজীবী সময় চাইতে পারেন * সম্পদের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তারা

বিপুল সম্পদের তথ্য প্রকাশ পাওয়ার ঘটনায় আলোচিত সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তান দুদকের তলবে আপাতত সাড়া দিচ্ছেন না। আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার পরিকল্পনা করেছেন। এর অংশ হিসাবে ৬ জুন বেনজীর এবং ৯ জুন স্ত্রী-সন্তানরা দুদকে হাজির হচ্ছেন না। নির্ধারিত দিনে তার আইনজীবী দুদকে হাজির হয়ে সময় চাইতে পারেন। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এদিকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীরের সম্পদের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান দলের সদস্যরা। তিন দফায় প্রায় হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার পরও নতুন করে বিভিন্ন জায়গায় সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুসন্ধান টিমের তিন সদস্যের পক্ষে দ্রুত কাজ শেষ করে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের আইনের মুখোমুখি করা সম্ভব নয়। এ কারণে দুদক কর্মকর্তাদের দিয়ে আরও কয়েকটি সাব টিম গঠন করে অনুসন্ধান কাজ এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে অনুসন্ধান প্রক্রিয়া ঝুলে যেতে পারে।

অন্যদিকে বেনজীরের দেশ ছাড়ার তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। গাজীপুর ও গোপালগঞ্জে জোর করে যাদের জায়গা দখলে নিয়ে রিসোর্ট তৈরি করা হয়েছে, তারা নিজেদের জায়গা ফেরত পেতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গাজীপুরের ভাওয়াল রিসোর্টের ঘটনায় বেনজীরের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়েছে।

২৮ মে অবৈধ সম্পদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানকে তলব করে নোটিশ পাঠানো হয়। বেনজীর আহমেদকে ৬ জুন এবং স্ত্রী জিসান মির্জা ও মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরকে ৯ জুন সশরীরে দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছে। দুদকের পক্ষ থেকে তলবি নোটিশ তার গুলশানের বাসায় পৌঁছানো হলেও তা এখনো পৌঁছেনি বেনজীর পরিবারের হাতে। নোটিশের কপি এখনো পড়ে আছে বাসার গার্ডরুমে। এ অবস্থায় বেনজীর পরিবারের অতিগোপনে দেশত্যাগ করার তথ্য প্রকাশ্যে আসে। তবে আইনজীবীও বেনজীরের অবস্থানের তথ্য প্রকাশ করছেন না। বেনজীর হাজির হবেন কি না, এ বিষয়েও খোলাসা করে কিছু বলছেন না।

তবে বেনজীরের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তান দুদকের ধার্য দিনে দুদকে হাজির হচ্ছেন না। তাদের পক্ষে আইনজীবীরা হাজির হয়ে সময় চাইতে পারেন। এক্ষেত্রে দুদকের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে, সে সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সময় আবেদন করলে অনুসন্ধান টিম তা কমিশনের কাছে পাঠাবেন। কমিশন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। এক্ষেত্রে কমিশন সর্বোচ্চ সাতদিন সময় দিয়ে আরেকটি নোটিশ পাঠানোর বিষয়ে অনুমোদন দিতে পারে। এরপরও হাজির না হলে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে দুদক আইনের ২৬(১) ধারা অনুযায়ী সম্পদবিবরণী দাখিলের আদেশ জারি, ২৭(১) ধারা অনুযায়ী জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা কিংবা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে অভিযোগ পরিসমাপ্তি করার বিধান রয়েছে। শেষ পর্যন্ত দুদকে হাজির না হলে সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এরই মধ্যে গাজীপুরে ভাওয়াল রিসোর্টের জমি দখলের ঘটনায় মামলা করেছেন স্থানীয় ভুক্তভোগীরা। ২ জুন গাজীপুরের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ নাজমুন নাহার মামলাটি আমলে নিয়ে সমন জারির নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার বাদী হয়েছেন ছয়জন। তারা হলেন ঢাকার কলাবাগান থানার সার্কুলার রোডের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল হক, তার ভাই ডা. সিরাজুল হক, বোন সামসুন্নাহার এবং ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা জাহিদুল হক, নিশাত তসলিম ও পারভীন। বাদীপক্ষের আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন সরকার সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলায় বিবাদীরা হলেন ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার প্রতিষ্ঠাতা ও আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেল, স্থানীয় উত্তর বানিয়ারচালা গ্রামের রফিকুল ইসলাম মাস্টার, ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার ম্যানেজার সুমন ও কামরুল ইসলাম।

একই সঙ্গে বিবাদী করা হয়েছে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), গাজীপুর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে। তবে রিসোর্টটি স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘আইজিপি রিসোর্ট’ হিসাবে পরিচিত। অভিযোগ আছে, সাবেক আইজিপি ক্ষমতার অপব্যবহার করে রিসোর্টটি তৈরি করেছেন। জানা যায়, ২৩ ও ২৬ মে দুদকের আবেদন আমলে নিয়ে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোম্পানির শেয়ার জব্দের (ক্রোক) নির্দেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। ওই আদেশের ফলে সোমবার পুঁজিবাজারের ইলেকট্রনিক্স শেয়ার সংরক্ষণাগার সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা সব বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) ফ্রিজ করে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় হিসাবগুলোয় শেয়ার ও অর্থ লেনদেন করা যাবে না।

আদালতের আদেশে দেখা গেছে, বেনজীর আহমেদের বিও হিসাব রয়েছে আইএফআইসি সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও ড্রাগন সিকিউরিটিজ লিমিটেড নামের ব্রোকারেজ হাউজে। আর সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস লিমিটেড ও ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডে তার স্ত্রী জিশান মির্জা, ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডে বড় মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর এবং ডাইনেস্টি সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বিও হিসাব আছে। বিএসইসির আদেশে বলা হয়েছে, মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ৫টি ব্রোকারেজ হাউজে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা ৬টি বিও হিসাব পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হলো। আদালতের আদেশ মোতাবেক ওই হিসাবগুলোর ওপর অবরুদ্ধকরণ আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় অর্থ উত্তোলন করা যাবে না।

আরও জানা যায়, ২৬ মে বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা ১১৯টি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। এগুলোর মধ্যে রাজধানীর গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট, সাভারের একটি জমি ছাড়াও মাদারীপুরের ১১৪টি দলিলের সম্পত্তি রয়েছে। এর আগে ২৩ মে ৮৩টি দলিলে ক্রয়কৃত সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। সেই সঙ্গে ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও তার সিকিউরিটিজের (শেয়ার) টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর ১৮ এপ্রিল তার সম্পদের তথ্য অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button