Bangladesh

হার্টের রিংয়ের দাম নির্ধারণ কার স্বার্থে

হার্টের রিংয়ের (স্টেন্ট) নতুন দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। এতে যুক্তরাষ্ট্রের তিন কোম্পানির ক্ষেত্রে ‘মার্কআপ ফর্মুলা’ অনুসরণ করা হলেও, রিং সরবরাহকারী ইউরোপের ২৪টি কোম্পানিকে এ তালিকায় রাখা হয়নি। দাম নির্ধারণে বৈষম্যের অভিযোগ এনে সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট করায় রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে রিং সংকট। সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় মূল্য নির্ধারণ কমিটির পরামর্শেই হার্টের রিংয়ের নতুন দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাম নির্ধারণে কমিটির অর্ধেকের বেশি সদস্যের মতামতই নেওয়া হয়নি। ফলে কার স্বার্থে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাবোট ল্যাবরেটরিজ, বোস্টন সায়েন্টিফিক ও মেডট্রোনিক কোম্পানির ক্ষেত্রে মার্কআপ ফর্মুলা মানা হলো– তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
গত ১২ ডিসেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ২৭টি কোম্পানির ৪৪ ধরনের হার্টের রিংয়ের দাম বেঁধে দেওয়া হয়, যা ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। এর পর বৈষম্যের অভিযোগ তুলে ইউরোপের ২৪টি রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ধর্মঘট ডাকে।

নতুন সিদ্ধান্তে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত রিংয়ের দাম কমেছে, যা হৃদরোগ চিকিৎসায় স্বস্তির বার্তা দেওয়ার কথা। বাস্তবে ঘটেছে এর উল্টো। ইউরোপভিত্তিক অ্যালেক্স প্লাস কার্ডিয়াক কোম্পানির রিং ৮০ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৫৩ হাজার নির্ধারণ করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। মার্কআপ ফর্মুলা মানলে দাম হতো ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা। আলটিমাস্টারের (ডিইএস) রিং ৮০ হাজার টাকা থেকে হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। মার্কআপ ফর্মুলা মানলে হতো ৭০ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে বায়োফ্রিডম কোম্পানির রিং ১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজারে। মার্কিন কোম্পানির সুবিধা পেলে এর দাম হতো ৮২ হাজার ৫০ টাকা।

এসব বৈষম্যের অভিযোগ এনে রিং সরবরাহকারী ব্যবসায়ীদের একাংশ ধর্মঘট করছে। এতে সঠিক আকৃতির রিং না পাওয়ায় বিভিন্ন হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে রোগীদের যেমন দুর্ভোগ বেড়েছে, তেমনি দ্বিগুণ দাম দিয়ে রিং কিনতে হচ্ছে। সংকট নিরসনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হৃদরোগ বিভাগ থেকে উপাচার্যের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ধর্মঘটের আগে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দৈনিক ৩৫ থেকে ৪০ জনের হার্টে রিং বসানো হলেও এখন তা নেমেছে ২০-২৫-এ। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে দৈনিক ৪০ জনের হার্টে রিং বসানো হলেও এখন তা ঠেকেছে অর্ধেকে। একই অবস্থা বিএসএমএমইউতে। এখানে আগে দিনে যেখানে ১৫ থেকে ২০টি রিং পরানো হতো, এখন তা ৮-১০টিও হচ্ছে না। রিংয়ের আকৃতি না মেলায় রোগীদের ফেরত পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

কার্ডিয়াক মেডিকেল ডিভাইসের মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্য ও রাজধানীর একটি নামি হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কমিটির সদস্য হলেও দাম নির্ধারণের বৈঠকে তাঁকে ডাকা হয়নি। যারা মূল্য নির্ধারণ করেছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো থেকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন বলে মনে করেন তিনি।
কমিটির আরেক সদস্য ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের চিফ কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. ফজিলা তুন নেছা সমকালকে বলেছেন, ‘বৈঠকেই ডাকেনি। ফলে কীভাবে রিংয়ের নতুন দাম নির্ধারণ হলো, তা বলতে পারব না।’

যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ডিএমসি) হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ও আইপিডিআই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা. ওয়াদুদ চৌধুরীর কেউই মন্তব্য করতে রাজি হননি।

যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত রিং সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেছেন, আলাদাভাবে বসে ফর্মুলা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি কোম্পানির রিংয়ের মূল্য ঠিক করা হয়। আলোচনা করে সব কোম্পানির দাম সমন্বয় করা দরকার ছিল। তবে সব ধরনের হার্টের রিংয়ের দাম ৭৫ হাজার টাকা দাবির সঙ্গে তিনি একমত নন।

মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওয়াসিম আহমদ বলেছেন, রোগীদের দুর্ভোগের জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। বিষয়টি নিরসনে মঙ্গলবার ঔষধ প্রশাসনে গেলে মহাপরিচালক বলেছেন, নির্বাচনের আগে জাতীয় মূল্য নির্ধারণ কমিটি বসতে চায় না। আমরা অবশ্য যখন ডাকবে, বসতে রাজি আছি।
কমিটির কিছু সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে মার্কআপ ফর্মুলা ছাড়া ইউরোপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের রিংয়ের দাম নির্ধারণ করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। সঠিকভাবে দাম সমন্বয় হলে দেশে সব ধরনের হার্টের রিং ৭৫ হাজার টাকায় দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী।

দাম নির্ধারণ বৈঠকে কমিটির ১৩ সদস্যের মধ্যে ছয়জন উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেছেন, অভিযোগ থাকলে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। জাতীয় মূল্য নির্ধারণ কমিটির ১৩ সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে বৈঠকের দিন জানানো হবে।

ধর্মঘটে রোগীদের দুর্ভোগ নিরসনে উদ্যোগ নেবেন কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না রোগীদের কোনো দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জাতীয় কমিটিও বলেছে, রোগীদের কোনো দুর্ভোগ হচ্ছে না। দুর্ভোগ হলে আমাদের জানাবে। তা ছাড়া কমিটি যদি মনে করে, বড় আকারের সমস্যা হচ্ছে, তাহলে তারা নিজেরাই আমাদের কাছে আসবে।’
ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে হার্টের রিংয়ের দাম তিন গুণ কেন– এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, ভারতে ব্যবসার ক্ষেত্রে খরচ অনেক কম। বিপরীতে জনবহুল হওয়ায় রিংয়ের ব্যবহার বেশি। বাংলাদেশের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ গুণ রিং ভারতে ব্যবহার হচ্ছে। অপারেট খরচ অনেক কম তাদের।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button