Bangladesh

হার্টের রিং নিয়ে অরাজকতা

হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত করোনারি স্টেন্টের (হার্টের রিং) নতুন খুচরা মূল্য ১২ ডিসেম্বর নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসন, যা ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রিংয়ের দাম কমেছে ১৫ থেকে ৪০ শতাংশ। তবে নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকরের দিন থেকে হাসপাতালে স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধ রেখেছে ইউরোপীয় আমদানিকারক ও সরবরাহকারীরা। মূল্য নতুন করে সমন্বয় না করা পর্যন্ত স্টেন্ট সরবরাহ ও বিক্রি বন্ধ রাখার কথা বলছেন তারা। তাদের এমন সিদ্ধান্তের ফলে হাসপাতালে রিং বসাতে আসা রোগীরা পড়েছেন মহাসংকটে। অনেক রোগীকেই ব্লকের পরিমাপ অনুযায়ী রিং না পেয়ে বাসায় ফিরে যেতে হয়েছে। আবার অপারেশন থিয়েটার থেকেও সাইজ অনুযায়ী রিং না পাওয়ায় ফিরে যেতে হয়েছে অনেককেই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এ সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন চিকিৎসা-সংশ্লিষ্টরা।

ঔষধ প্রশাসনের তথ্যমতে, দেশে হার্টের রিং আমদানি করে ২৭টি কোম্পানি। এর মধ্যে তিনটি যুক্তরাষ্ট্র ও বাকি ২৪টি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ রিং আমদানি করে আনে। এ ছাড়া জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত থেকেও রিং আমদানি করা হয়। নতুন মূল্য তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের রিংয়ের দাম ধরা আছে ২০ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর অন্যান্য দেশ ইউরোপীয় দেশ থেকে আমদানি করা রিংয়ের মূল্য সর্বনিম্ন ১৪ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আয়ারল্যান্ডের রিং আছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। তবে প্রতিটি দেশের রিংয়ের আলাদা ক্যাটাগরি ভাগ করা থাকে এবং সে অনুযায়ী দাম ওঠানামা করে। ডাক্তার কোনো রোগীকে রিং বসানোর পরামর্শ দিলে রোগীর পক্ষ থেকে পছন্দসই দামের রিং চূড়ান্ত করা হয়। যার অর্ডার নেয় ভেন্ডর বা হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানি এবং তারাই সেটা হাসপাতালে সরবরাহ করে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, কমিটি গঠন করে, মিটিং করে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে নতুন মূল্য তালিকা দেওয়া হয়েছে। দাম নির্ধারণের আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। কারও যদি দাম নিয়ে সমস্যা থাকে আবারও আলোচনা করা যাবে। কিন্তু রোগীদের জিম্মি করতে দেওয়া হবে না। যারা করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দেশে হার্টের রোগীদের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা কেন্দ্রের নাম জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। উন্নত চিকিৎসাসেবা ও কম টাকায় চিকিৎসা নিতে হার্টের রোগীরা এ হাসপাতালে ভিড় করেন। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন এ হাসপাতালে। হৃদরোগ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০-৩৫ জনের হার্টের রিং পরানো হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, হৃদরোগে আক্রান্ত কিছু রোগীর রক্তনালি সরু বা বন্ধ (ব্লক) হয়ে যায়। এতে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। রক্ত চলাচল সচল রাখতে স্টেন্ট ব্যবহার করা হয়। রবি ও সোমবার এ দুদিনে একাধিক রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এমনকি অপারেশনের শিডিউল থাকার পরও সাইজ অনুযায়ী সোমবার দুজন রোগীর অপারেশন করা যায়নি।

হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত বছর এই হাসপাতালে ছয় হাজারের বেশি রোগীকে হার্টের রিং পরানো হয়। এ রোগীদের মধ্যে ৬০-৬৫ শতাংশকে ইউরোপ থেকে আমদানি করা রিং পরানো হয়েছে।

হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক মীর জামাল উদ্দীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, দাম নির্ধারণ নিয়ে রোগীদের জিম্মি করার চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। দাম কমানো কিংবা মূল্য নিয়ে কারও যদি আপত্তি থাকে তাহলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সঙ্গে বসে তারা আলাপ করবেন। কিন্তু কোনোভাবেই হার্টের রিংয়ের মতো জরুরি উপাদানের সরবরাহ তারা বন্ধ করতে পারবেন না। এখন শীতকাল, ফলে হার্টের রিং পরাতে আসা রোগীদের সংখ্যা কম আবার তারা সরবরাহ বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটাও অল্প কদিন হলো, ফলে এখনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু সরবরাহ বন্ধ থাকলে রোগীদের ঝুঁকি বেড়ে যাবে এবং বাজারে রিং কিনতে পাওয়া যাবে না। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পরিস্থিতি খারাপ হবে।

গতকাল সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন দেশ রূপান্তরকে বলেন, এনজিওগ্রাম করা হলে তার বাবার হার্টে ব্লক ধরা পড়ে। হার্টের ব্লক সারাতে তাকে অস্ত্রোপচার কক্ষে নেওয়া হয়। তবে ব্লকের পরিমাপমতো রিং না থাকায় কয়েক দিন পর হাসপাতালে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এখন তাকে বাসায় নিয়ে যেতেও ভয় লাগছে, যদি কিছু হয়ে যায়।

ঢামেকের হৃদরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, ‘আজ (গতকাল) ঢামেকে চারজন রোগীকে হার্টে রিং পরানো হয়েছে। রিং সরবরাহ বন্ধ রাখার প্রভাব এখনো পুরোপুরি পড়েনি কিন্তু এর প্রভাব পড়তে সময় লাগবে না। হার্টের রিং জীবন রক্ষাকারী উপাদান। এটার সরবরাহ বন্ধ রেখে হাসপাতালে ডাক্তার ও রোগীদের জিম্মি করার যে প্রবণতা, এটা খুবই খারাপ। অনেক চেষ্টা করে দাম এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। নতুন দামের পরও কিন্তু আমদানিকারকদের মুনাফা হচ্ছে কিন্তু তাদের আরও মুনাফা প্রয়োজন। কোম্পানিগুলোর হুমকিতে আমাদের রাজি হয়ে যাওয়া ঠিক তবে না। সরকারকে কঠোর হতে হবে।’

মেডিকেল ডিভাইস ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন পাঁচটি হাসপাতালে ইউরোপীয় স্টেন্ট আমদানি করা স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধের চিঠি দিয়েছে। স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধের চিঠি পাওয়া হাসপাতালগুলো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন। এ পাঁচটি হাসপাতালেই মূলত হৃদরোগের চিকিৎসা বেশি হয়। এ হাসপাতালগুলোকে আগে সরবরাহ করে রাখা স্টেন্ট ব্যবহার না করার অনুরোধ করা হয়েছে।

মেডিকেল ডিভাইস ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর আমাদের যখন ডাকলেন সে সময় দাম নির্ধারণ কমিটিও ছিল। আমরা সেই সভায় দাবি করেছিলাম, বর্তমান ডলারের বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হার্টের রিংয়ের দাম নির্ধারণ করার। ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে আগে যে প্রোডাক্টের (হার্টের রিং সংশ্লিষ্ট) দাম ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার, সেটা হয়ে যায় ১ লাখ ৮২ হাজার টাকার বেশি। ডলারের দাম ৮৬ থেকে ১১০ টাকায় উঠেছে। ফলে সব জায়গায় প্রচার হয় হার্টের রিংয়ের দাম বেড়েছে কিন্তু এর সঙ্গে যে ডলারের দাম বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে, সেটা কেউ বলল না। এখন আমেরিকা থেকে যারা হার্টের রিং আমদানি করেন তাদের ক্ষেত্রে মার্কআপ ফর্মুলা মেনে দাম নির্ধারণ করা হলেও ইউরোপীয় আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে তা মানা হয়েছে।’

ধর্মঘটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়নি। এটা ইউরোপীয় আমদানিকারক ব্যবসায়ী ও সরবরাহকারীদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’

রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মাসুম সিরাজ অবশ্য আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে একমত নয়। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে হার্টের রিংয়ের যে দাম নেওয়া হয়, তা পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল ও ভারতের থেকে অনেক বেশি। এমনকি নতুন দাম কার্যকরের পরও ওই দুটি দেশে আমাদের চেয়ে কম দামে হার্টের রিং বিক্রি হচ্ছে। আমাদের ব্যবসায়ীরা অধিক লাভ করার যে প্রবণতা সেই কারণে তারা নতুন মূল্য মেনে নিতে পারছেন না। মানুষ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ কিংবা সরঞ্জাম তো মুনাফার জন্য নয়, এটা তারা বুঝতে চান না।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button