Hot

হাসপাতালে এখনো কাতরাচ্ছে আহতরা

এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতরা। বিভিন্ন হাসপাতালে গুরুতর আহতদের এখনো চিকিৎসা চলছে। তাদের অনেকের অঙ্গহানি হয়েছে। কেউ হাত হারিয়েছে। কেউ পা। কারও চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে বুলেট। এমন আহতদের নিয়ে দুঃসহ সময় পার করছেন স্বজনরা। সরকারের নির্দেশনায় বিনা খরচে তাদের চিকিৎসা চললেও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পরিবার। 

আন্দোলনে যারা আহত হয়েছে তাদের বড় অংশই চিকিৎসা নিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জাতীয় অর্থোপেডিকস হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল)। গতকাল এই দুটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, অনেক রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আবার অনেকেই সাধারণ বেডে ও আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছে। অনেকের অবস্থা গুরুতর। তারা বাঁচার লড়াই করছে। আন্দোলনে আহত হওয়ার কারণে চিকিৎসকরা তাদেরকে আলাদাভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। 

সরজমিন গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরাতন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় হাসপাতালের তিনটি ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।  হাসপাতালটিতে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে রোগী আসা শুরু করেন। তাদের মধ্যে যাদের আঘাত গুরুতর ছিল না তারা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আর যাদের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে বুলেট প্রবেশ করেছে এবং একাধিক বুলেট বিদ্ধ হয়েছে তারা এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মাথায়, বুকে, চোখে, হাতে-পায়ে শতাধিক ছররা গুলিবিদ্ধ রোগীও সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছে। হাসপাতালের নার্স ও চিকিৎসকরা বলছেন, আমরা এসব রোগীদের বিষয়ে খুবই সচেতন। তাদেরকে দ্রুত সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছি। যাদের শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হচ্ছে তাদেরকে আইসিইউতে পাঠাচ্ছি। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, এখনো ৩৯ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে বার্ন ইউনিটের তিনটি ওয়ার্ডে কিছু রোগীকে রাখা হয়েছে। বেশি ক্রিটিক্যাল রোগীদের আইসিইউ’তে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আন্দোলনে যারা আহত হয়েছিলেন তাদেরকে আলাদা করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের জন্য সার্বক্ষণিক ডিউটি ডাক্তার, নার্স রয়েছেন। চিকিৎসা খরচও ফ্রি করা হয়েছে। 

পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আন্দোলনে আহতরা আগে হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-১, ক্যাজুয়ালিটি-২ সহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিক্ষিপ্তভাবে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে আসলেও বর্তমানে তাদের জন্য ৩য় ও ৪র্থ তলায় দুটি বিশেষায়িত ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানেই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।  হাসপাতালটির ৩য় তলার বি-ওয়ার্ডে (পুরুষ) গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার ৪৮টি বেডের ৩৫টিতে এখনো রোগীরা যন্ত্রণাতে কাতরাচ্ছেন। কেউ পা হারিয়েছেন, কারও হাতে গুলি লেগেছে, কারোর পায়ে লোহার রিং পরানো, কেউ ব্যথাতে নড়াচড়াও করতে পারছে না। সকলেরই চোখে মুখে বিষণ্নতার ছাপ। এমনই একজন ঢাকা আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আহমেদ। ছোট বেলা থেকেই সেনাবাহিনীর অফিসার হতে চেয়েছে। তবে গত ৪ঠা আগস্টের পর থেকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে এই শিক্ষার্থী। একাধিক অস্ত্রোপচারের পর ডান পায়ে লোহার পাত পরানো রয়েছে। আব্দুল্লাহ আহমেদ বলেন, শুরু থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। মিরপুরে বাসা হওয়ায় ওই এলাকায় বেশি ছিলাম। সরকার পতনের ঠিক আগের দিন দুপুরে প্রথমে আমি অন্য সকলের সঙ্গে ইসিবি চত্বরে ছিলাম। সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা মিরপুর দশ নম্বরের দিকে যাচ্ছিলাম। বিআরটিএ অফিসের সামনে পৌঁছালে দশ নম্বরের দিক থেকে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলি উপেক্ষা করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এরইমধ্যে রাস্তার পাশে থাকা পুলিশের একটি গাড়ি হঠাৎ ব্যাক গিয়ার দিয়ে পেছনের দিকে এসে আবার সামনের দিকে চলে যায়। বেশ কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেও আমার ডান পা চলে যায় ওই গাড়ির নিচে। পায়ের হাড় ভেঙে গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যায় আমার। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে দেখি আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেদিন থেকেই হাসপাতালের বেডে। কয়েকবার অপারেশন করা হয়েছে। 

আরও অপারেশন বাকি আছে। ডাক্তার বলেছে আরও অন্তত এক বছর লাগবে আমার সুস্থ হতে। আর সুস্থ হলেও আগের মতো পা ভাঁজ করতে পারবো না। আব্দুল্লাহ বলেন, অনেক স্বপ্ন ছিল আর্মি অফিসার হবো। আমার সেই স্বপ্ন আর সত্যি হবে না। আব্দুল্লাহ যখন এসব কথা বলছিল তখন তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।

আব্দুল্লাহর সামনের বেডেই চিকিৎসা নিচ্ছে মো. অ্যামেলি। পুরান ঢাকার চক বাজারে কসমেটিকের দোকানের এই সেল্‌সম্যানও ৪ঠা আগস্ট শাহবাগের আন্দোলনে যোগ দেয়। অ্যামেলি বলে, বিকাল তিনটা পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। হঠাৎ দেখি ফার্মগেট, কাওরান বাজারের দিক থেকে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসছেন। আমরাও তখন সামনে এগিয়ে যাই। বাংলামোটর, কাওরান বাজার পার করে সামনের দিকে এগিয়ে রাস্তার ওপর একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। হঠাৎ একটি ছাদের ওপর থেকে আমার বাম হাতে গুলি লাগে হাত ঝুলে যায়। গুলি আমার হাতের শিরা ছিঁড়ে হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। এরপরই আরেকটি গুলি এসে লাগে আমার পেটে। আমি তখন রাস্তার উপর লুটিয়ে পড়ি। আশপাশের লোকজন আমাকে তখন ধরাধরি করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কয়েকদফা অস্ত্রোপচারের পর আমাকে আবার নিয়ে আসা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। এই ৪০/৪৫দিন এখানেই ভর্তি রয়েছি। কোনো আয়-ইনকাম নেই। তিনি বলেন, এখানে কোনো চিকিৎসা ব্যয় নেই। ওষুধ, চিকিৎসা, অপারেশন সব ফ্রি । কিন্তু নিজেদের তো খরচ আছে। সেগুলো তো আর কেউ দেয় না। আয়-রোজগার না থাকায় দীর্ঘদিনের চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি।  কবে এর থেকে পরিত্রাণ পাবো তাও জানি না। 

আব্দুল্লাহ-অ্যামেলির মতো একই ওয়ার্ডের বি-৪২ নম্বর বেডে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৯ বছরের  সাদ আব্দুল্লাহ। ৪ তারিখের আন্দোলনে তার ডানপায়ে গুলি লাগে। একাধিক অস্ত্রোপচার করে তার পা থেকে গুলি বের করা হলেও এখানো পায়ে স্টিলের রডের খাঁচা পরানো। তারও বছর খানেক সময় লাগবে এই খাঁচা খুলতে। তারপরও পা আগের মতো স্বাভাবিক হবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে তার সন্দেহ। দশম শ্রেণির ছাত্র আলী হাসানও গত ৫ই আগস্ট ডানপায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। তাকেও সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে তিনিও ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসান বলে, গুলি লাগার পর আমাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। অনেক চেষ্টার পরও  গত ১৪ই আগস্ট আমার ডান পা হাঁটুর নিচে থেকে কেটে ফেলে এখানকার ডাক্তাররা। ১৬ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর ৩০শে আগস্ট আমি সাতক্ষীরা ফিরে যাই। কিন্তু বাড়ি ফিরে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে আমার পায়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এরপর গত ১৬ই সেপ্টেম্বর আবারো আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসে আমার পরিবার। সেদিন থেকে এখানেই ভর্তি আছি। সারা জীবনের মতো আমার পা-টা হারালাম।  বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ৭৬৮ জনের মধ্যে আব্দুল্লাহ, অ্যামেলি, সাদ, হাসান, আতিকুল, আসলামের মতো এখনো অনেকে পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন।  যাদের মধ্যে  ২১ জনের অঙ্গহানি হয়েছে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button