Bangladesh

হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন গুলিবিদ্ধ বহু মানুষ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ বহু মানুষ এখনো রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। তাদের কেউ শ্রমজীবী, দিনমজুর আবার কেউ ছাত্র। তাদের অনেকেই চোখ, হাত ও পায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারিয়েছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, আহতের শরীরে একাধিকবার অস্ত্রোপচারের পরও অঙ্গহানির শঙ্কা কাটেনি। স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। কারও কারও এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।

এছাড়া যত দিন যাচ্ছে, আহতদের শরীরে দেখা দিচ্ছে নানা জটিলতা। গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসা ব্যয় এবং সাংসারিক খরচের জোগান দিতে গিয়ে রীতিমতো দুচোখে সরষে ফুল দেখছেন তাদের স্বজনরা। শুধু তাই নয়, সুস্থ করে তোলা সম্ভব হলেও এসব মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন পরিবার ও স্বজন। গুলিবিদ্ধদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদের কাউকে গুলির আঘাতে হাত কিংবা পা খুইয়ে পঙ্গুত্ববরণ করতে হবে। আর কাউকে কাউকে যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন কাটাতে হবে বিছানায়। গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয়ে রয়েছে তাদের পরিবার। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ঘোষণা দিয়েছেন, আহত গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে সরকার। তবে ভোক্তভোগীদের প্রশ্ন-উপার্জনক্ষম মানুষটি অক্ষম হয়ে গেলে তাদের সংসারের চাকা ঘুরবে কেমন করে?

খিলগাঁও কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. আলী আজগর (২১)। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ায়। পরিবারের সঙ্গে কদমতলীর মোহাম্মদবাগ এলাকায় থাকতেন তিনি। বাবা মো. হোসেন রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালান। আজগর আলী সহপাঠীদের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগের পর বিজয় মিছিল বের করা হয় যাত্রাবাড়ীতে। যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আসতেই একদল যুবক থানায় আগুন দেয়। অন্যদিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। একটি গুলি আলী আজগরের পেছনে বামপাশে বিদ্ধ হয়। পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।

সোমবার ঢাকা মেডিকেলের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ১৪ নম্বর বেডে আলী আজগর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। আলী আজগরের বাবা মো. হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাই। ছেলে আহত হওয়ার পর থেকে কাজেও যেতে পারি না। ছেলের পাশেই আছি। ধারকর্জ করে সংসার খরচ এবং ছেলের চিকিৎসা খরচ চালাচ্ছি। জানি না আমার ভবিষ্যৎ কী হবে। আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠবে কি না। সে যদি সুস্থ না হয়, তবে আমি মরে গেলে আমার এ ছেলেকে দেখবে কে?

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একই ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন পিংকু মিয়া (৪৩)। তিনি ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে জীবিকানির্বাহ করতেন। থাকতেন শনিরআখড়ায়। ২০ জুলাই শনিরআখড়ায় আন্দোলনে যোগ দিলে একপর্যায়ে তার কোমরের বাম পাশে এবং হাতে গুলি লাগে। তার পাশে বসে কান্না করছিলেন বোন পলি বেগম। তিনি জানান, তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে। পিংকু মিয়া অবিবাহিত। শনিরআখড়া ব্যাটারি গলিতে থেকে রিকশা চালিয়ে যা আয় করতেন, তা দিয়েই তাদের সংসার চলত। এখন তো ভাই নিজেই পঙ্গু হয়ে গেল।

ঢামেক হাসপাতালের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন গাইবান্ধার শৌলাবাড়ি গ্রামের শহিদুল ইসলাম। তিনি পরিবার নিয়ে কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুরের ৪নং গলিতে ভাড়া বাসায় থাকেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করে তিনি জীবিকানির্বাহ করেন। ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে লালবাগ থানার সামনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার তলপেটে একটি গুলি লাগে।

শহিদুলের স্ত্রী রাশিদা বেগম যুগান্তরকে বলেন, তাদের এক ছেলে এক মেয়ে ছিল। এর মধ্যে মেয়েটা ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে ৫ মাস আগে মারা যায়। এরই মধ্যে স্বামীর এমন অবস্থায় ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, এখনো এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আহত ও গুলিবিদ্ধ ১৫৯ জন রোগী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, ভর্তি রোগীদের অনেকের অবস্থাই ক্রিটিক্যাল। একেকজনের নানান জটিলতা দেখা দিচ্ছে। আমরা তা সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। এ

দিকে পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকায় বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ ঢাকা কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান সরকার। এই তরুণ বলেন, এরই মধ্যে পায়ে সাতবার অপারেশন করা হয়েছে। প্রতিবার মেরুদণ্ডে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করে অচেতন করা হয়। এখন মেরুদণ্ডে সমস্যা দেখা দিয়েছে, সোজা হয়ে বসতে পারছি না। আরও সাতবার অপারেশন করা লাগবে। পা যদি ভালো করতে হয়, এভাবেই চিকিৎসাধীন থাকতে হবে দুই বছরের বেশি সময়। তিনি জানান, চিকিৎসকরা আল্লাহকে ডাকতে বলেছেন।

৪ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন শাকিল আহম্মেদ (১৮)। পরে পরিবার ও সহপাঠীদের সহযোগিতায় নেওয়া হয় মিরপুরের একটি হাসপাতালে। সেখান থেকে আনা হয় কল্যাণপুর ইবনে সিনা হাসপাতালে। আহত শাকিল মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ভান্ডারীকান্দি ইউনিয়নের ক্রোকচর সরদারকান্দি এলাকার মৃত শিরাজ হাওলাদারের ছেলে। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে শাকিল ছোট। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে শাকিলের বাবা মারা যাওয়ার পর ছোটবেলা থেকেই তাদের নিয়ে মা সেলিনা বেগম চলে আসেন রাজধানীতে। শাকিল শ্যামলী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। তারা ঢাকার মিরপুর ১ নম্বর এলাকায় থাকেন। শাকিলের বোন শাকিলা আক্তার ইবনে সিনা হাসপাতালে চাকরি করেন।

তিনি জানান, একটি বুলেট বিদ্ধ হয় শাকিলের মলদ্বারে। আরেকটি গুলি লেগে পায়ের রগ ছিঁড়ে যায়। ইতোমধ্যে তিনটি অপারেশন হয়েছে। এতে প্রায় ৩ লাখ টাকা বিল এসেছে। চিকিৎসক বলেছেন, আরও দেড় থেকে দুই মাস হাসপাতালে থাকতে হবে। একমাত্র ভাইয়ের অনিশ্চিত জীবন। চিকিৎসার জন্য দরকার অনেক টাকা আর রক্ত। এমন পরিস্থিতিতে সবকিছুর হাল ধরতে হয়েছে আমাকে। এ মুহূর্তে আমাদের অর্থনৈতিক সাহায্য দরকার। নতুবা তার চিকিৎসা চালানো সম্ভব হবে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button