হাসিনাকে ফেরানোর উদ্যোগ
অনুপ চেটিয়াকে ২০১৫ সালে দিল্লির হাতে তুলে দেয় ঢাকা দু’দেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ঢাকার হাতে তুলে দিতে ভারতকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ
২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় আসামের স্বাধীনতাকামী সংগঠন উলফার শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়া, লক্ষ্মী প্রসাদ গোস্বামী, বাবুল শর্মাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। একই প্রক্রিয়ায় দিল্লিতে পলাতক শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তরের জন্য চিঠি দিয়েছে ঢাকা। এখন চুক্তি অনুযায়ী হাসিনাকে ঢাকার হাতে হস্তান্তর করা না করার উপর নির্ভর করবে প্রতিবেশী দুই দেশের আগামী দিনের সম্পর্ক।
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা, ১৬ বছরের শাসনামলে গুম-খুন এবং অর্থপাচারের দায়ে অভিযুক্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় স্বৈরাচার পলাতক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী তাকে ঢাকায় ফেরত পাঠাতে ভারতের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব সম্বলিত দিল্লিকে ঢাকার চিঠির কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। গতকাল সোমবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও একই কথা জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য বাংলাদেশ ফেরত চেয়েছে। এটা ভারতকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে ভারতকে নোট ভারবাল পাঠানো হয়েছে।’ এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতকে অনুরোধ জানাতে এরই মধ্যে আমাদের (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের) চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটা প্রক্রিয়াধীন আছে। আমাদের সঙ্গে তাদের একটা এক্সট্রাডিশন (প্রত্যর্পণ) চুক্তি আছেই।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে হত্যাকা-, গত ১৬ বছরে গুম-ক্রসফায়ার, পিলখানা হত্যাকা- এবং মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকা- মোটাদাগে এই কয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এসেছে। শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভা, বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা চলমান।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তি কার্যকর রয়েছে। ২০১৩ সালে ভারত-বাংলাদেশ বন্দি বিনিময় চুক্তি করে। ২০১৫ সালে এই চুক্তির আওতায় আসামের স্বাধীনতাকামী সংগঠন উলফার শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়া এবং তার দুই সহযোগী লক্ষ্মী প্রসাদ গোস্বামী ও বাবুল শর্মাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০১৮ সালে বাদল ফারাজি নামের একজন বাংলাদেশীকে ভারত বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে।
বাংলাদেশ-ভারতের বন্দি বিনিময় চুক্তিতে বলা হয়েছে, ন্যূনতম এক বছরের সাজা হতে পারে এমন মামলায় আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেই ভারত বা বাংলাদেশকে পলাতক বন্দি হস্তান্তর করতে হবে। যদি অপরাধ রাজনৈতিক হয়, প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। তবে হত্যা, গণহত্যা, বোমা হামলা, গুলি করে হত্যা, সম্পত্তির ক্ষতি, গুম-অপহরণ বা জিম্মি করা এবং হত্যার প্ররোচনার মতো অপরাধের মামলায় দুই দেশেরই পলাতক আসামিকে ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে চুক্তিতে।
গত ২২ ডিসেম্বর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিশ জারি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন থেকে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সংবাদ সম্মেলন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির বিষয়ে যে নির্ধারিত ফর্ম আছে তা পূরণ করে একটি চিঠির মাধ্যমে ফরওয়ার্ডিং করে এনসিবির কাছে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের একটি শাখা আছে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) নামে। তারা ইন্টারপোলের যত বিষয় আছে তা দেখভাল করেন। গত ১৩ নভেম্বর চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির বিষয়ে যে নির্ধারিত ফর্ম আছে তা পূরণ করে একটি চিঠির মাধ্যমে ফরওয়ার্ডিং করে পুলিশের এই এনসিবি সংস্থার কাছে পাঠিয়েছি। ভারতের সঙ্গে অপরাধী প্রত্যর্পণের যে চুক্তি আছে, সেই চুক্তির অধীনে অপরাধীদের দেশে ফেরানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের নিতে হবে।
১৭ অক্টোবর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা পড়া অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাকে আগামী ১৮ নভ্ম্বেরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন আমলের সব হত্যা, গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পিলখানা হত্যার বর্ণনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করতে ২০১০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। সেই ট্রাইব্যুনালে জামায়াত-বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে দ- ঘোষণা করা হয় এবং তা কার্যকরও হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগষ্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন ঠেকাতে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় শেখ হাসিনা সরকার। প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারায় এই আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে। শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারের দায়িত্বে আসে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের পরই জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচার করার সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্র আন্দোলনের সময় কয়েক শ’ মৃত্যুর ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বিবেচনা করে শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কয়েক ডজন মানুষের বিরুদ্ধে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে এরই মধ্যে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের দপ্তরে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বৈঠক করেন। সেই বৈঠকের পর শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় তোলা এখন জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ৫ আগষ্টের পর থেকেই এ দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবি শেখ হাসিনার বিচার না করা পর্যন্ত নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।