Hot

হাসিনার ‘ইনডেমনিটি’ বাতিল

বিদ্যুৎ সেক্টরে দুর্নীতির বিচারের দরজা খুলে গেল হাসিনা রেজিমের আদানির সঙ্গে অসম চুক্তি, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও বিচার প্রক্রিয়া শুরুর বাধা দূর হলো

বিদ্যুৎ সেক্টরের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিচার বন্ধে ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ (দায়মুক্তি) জারি করে জাতীয় সংসদে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ করা হয়েছিল। বিদ্যুৎ সেক্টরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও বিচার বন্ধে এই ‘ইনডেমনিটি’ আইন পাস করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ গত ২০ নভেম্বর ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ জারির প্রস্তাব নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। অতঃপর গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন বিদ্যুৎ সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে হাসিনার করা ‘ইনডেমনিটি’ আইনটি বাতিল করে অধ্যাদেশ জারি করেছেন। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে শেখ হাসিনার শাসনামলে রেন্টাল-কুইট রেন্টাল বিদ্যুৎ ক্রয় ও বিদ্যুৎ সেক্টরের মেগা মেগা দুর্নীতির বিচারের পথে আর কোনো বাধা রইল না। বিদ্যুৎ সেক্টরে দুর্নীতির দায়ে মামলা ও বিচারের দরজা খুলে গেল।

‘ইনডেমনিটি’ শব্দটিকে বাংলাদেশের মানুষ নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকেন। মূলত মুজিব হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের বিচার বন্ধে মোশতাক সরকার এই আইন পাস করায় এটিকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশ করা হয়। এটিকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করলেও দলটি নিজেও জাতীয় সংসদে দুর্নীতির বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি বিল পাস করেছিল। আওয়ামী লীগ রাজনেতিক কার্ড হিসেবে প্রচার করে বঙ্গবন্ধুর খুনিকের বিচার ঠেকাতে ইনডেমনিটি দেয়া হয়। অথচ শেখ হাসিনাও বিদ্যুৎ সেক্টরের দুর্নীতির বিচার ঠেকাতে ইনডেমনিটি বিল পাস করেছিলেন। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যম শেখ হাসিনার অলিগার্ক ও দিল্লির সেবাদাস হওয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের সব রাস্তা বন্ধ করতে দেয়া ইনডেমনিটি নিয়ে তেমন প্রচারণা করেনি।
ক্যালেন্ডারের পেছনের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গ হত্যাকা-ের (কারো কারো দাবি অভ্যুত্থান) সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা (শাস্তি এড়াবার) ব্যবস্থা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ওই ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। এতে শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচারের পথ খুলে যায়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেন বাংলাদেশ হাইকোর্ট। অতঃপর ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের বিচার করা হয়।

ঠিক তেমনি, ভারতের নীল-নকশা অনুযায়ী ২০০৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ সেক্টরে উন্নতির জন্য বিশেষ লুটপাটের মহাব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দলীয় লোকজনকে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের লাইসেন্স দেয়া হয়। অতঃপর ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ সংসদে পাস করা হয়। এই আইনে বিদ্যুৎ সেক্টরে দুর্নীতিকে দায়মুক্তি তথা ইনডেমনিটি দেয়া হয়। ফলে ওই আইনের কারণে শেখ হাসিনার সময় বিদ্যুৎ সেক্টরের কোনো দুর্নীতির বিচার করা এবং দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ওই আইনে বলা হয়, ‘এই আইনের অধীন কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ এতে আরো বলা হয়, ‘এই আইন বা তদ্বধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’

বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির দায়মুক্তি দিয়ে আইন পাস করার পর ওই খাতে লুটের মহোৎসব হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ খাতকে দুর্নীতির প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল। গত ১৩ বছর রেন্টাল এবং আইপিপি খাতে সরকার কেবল ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করেছে ৯০ হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। যার মধ্যে সরকারের অতিঘনিষ্ঠ ১২টি কোম্পানিই নিয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক বা না হোক, সরকার বিদ্যুৎ ক্রয় করুক বা না করুক, বিনা টেন্ডারে কাজ দেয়া প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে প্লান্ট ভাড়া বাবদ দিতে হয়েছে পূর্বনির্ধারিত এই বিশাল অর্থ। অথচ চাহিদা না থাকায় ‘দেশের অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র অলস পড়ে আছে।’

নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করতে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ (কয়লাভিত্তিক) ক্রয়ের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় আদানি পাওয়ারকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দিতে হয় এক লাখ ১৭ হাজার ৫৮ কোটি টাকা (এক ডলার=১০৬.৩২ টাকা), যা দেশের কয়লাচালিত অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। আদানি গ্রুপকে কয়লার দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রতি টন ৪০০ ডলার, অথচ বাজারে ২০০ ডলারের নিচে। আদানিকে মাসে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা শুধু কয়লা বাবদ গচ্ছা দিতে হচ্ছে। চার মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ এক হাজার ২১৯ কোটি টাকা জরিমানা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য পড়ছে ২৪.২৮ টাকা। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আদানি বকেয়া বিলের দাবিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু সরকার বকেয়া বিল পরিশোধ করেছে।

২০১৫ সালে জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার ৮০ শতাংশ ঋণ সহায়তায় প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারের মহেশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হয়। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপক লুটপাট ও অনিয়মের অভিযোগ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সমুদ্রের প্রয়োজনীয় গভীরতা না থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র রাজনৈতিক কারণে এক হাজার ৭০০ কোটি ডলার মূল্যের পায়রা বন্দর প্রকল্পটি গৃহীত হয়। এই বন্দরকে কেন্দ্র করে ড্রেজিংয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ভেঙে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়ে বেলজিয়ামের একটি কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে, যা যৌক্তিক হয়নি। ইতোমধ্যে সরকার এ বন্দর প্রকল্প থেকে সরে এসেছে।

‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ বাতিলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সেক্টরের দুর্নীতির বিচারের দরজা খুলে গেল। তবে ২০১০ সালের আইনটি বাতিল করা হলেও ওই আইনের অধীনে হওয়া চুক্তি বাতিল হবে না।

গত ১৪ নভেম্বর ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ এর ধারা ৬(২) ও ধারা ৯ হাইকোর্ট বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করেন।

জানতে চাইলে তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রফেসর আনু মুহাম্মদ বলেন, আদানির সঙ্গে বিদ্যুতের যে চুক্তি হয়েছে এটি কোনো চুক্তি নয়; বরং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী আদানিকে শেখ হাসিনা উপহার দিয়েছেন। অন্যায্য চুক্তির দিক থেকে সব রেকর্ড ভেঙেছে আদানির এই চুক্তি। এখন ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ নামের দায়মুক্তির আইন বাতিল হওয়ায় এ সেক্টরের দুর্নীতির বিচারের পথ খুলে যাবে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে হাসিনার আমলে ‘গণভবনের লোকজনকে নিয়ে একটি চক্র গড়ে উঠেছিল’। বিদ্যুৎ সেক্টরে তারা সিন্ডিকেট করে লুটপাট করেছে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, বিদ্যুৎ খাতে কুইক রেন্টাল চুক্তির বিষয়ে আদালতের রায় এলেও সহজে চুক্তি থেকে বের হওয়া যাবে না। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের অনিয়ম খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto