Hot

হাসিনার বিচারের পর নির্বাচন

১৫ দিনের মধ্যে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ জারির আল্টিমেটাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিতে লাখো ছাত্র-জনতার উপস্থিতি

রাতভর নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বানে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি থেকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিচার এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। লাখো ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ’সহ নানা সেøাগানে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে আমাদের সংগ্রাম জারি থাকবে জানিয়ে বক্তারা বলেছেন, আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে। পিলখানা হত্যাকা-ের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। শাপলা চত্বরে লাইট নিভিয়ে আলেম-ওলামাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সেগুলোর বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আওয়ামী লীগ যে গুম-খুন করেছে তার বিচার করতে হবে। সারাদেশের মানুষের কাছে যাবেন। তাদের কথা শুনবেন যে তারা কী চায়।

মূলত ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণার লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি এই সমাবেশের ডাক দেয়। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, পেশাজীবী সকলের মতামত নিয়ে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেয়ার ঘোষণা দেয়া হবে। এরপর শিক্ষার্থীরা কর্মসূচির নাম পাল্টিয়ে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’র আয়োজন করেন। ছাত্র-জনতার এই সমাবেশ কেন্দ্র করে গতকাল কার্যত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানুষের ঢল নামে; পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্যে পরিণত হয়। সকালের দিকে উপস্থিতি কম দেখা গেলেও দুপুরের পর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দেশের বিভাগ এবং জেলাগুলো থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। অংশগ্রহণকারীদের কারো মাথায় জাতীয় পতাকা, কারো হাতে জাতীয় পতাকা, পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের পতাকাও অনেকের হাতে দেখা গেছে। এছাড়া হাজার হাজার ছাত্র-জনতার হাতে দেখা যায় বিভিন্ন সেøাগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড। এ সময় ‘আবু সাইদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘স্বৈরাচারের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’, দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’, ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’, ‘রশি লাগলে রশি নে, খুনি হাসিনার ফাঁসি দে’, ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ মুর্দাবাদ’, গোলামি না আজাদী, আজাদী আজাদী’, দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না’, বিপ্লবীদের অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘একটা একটা খুনি ধর, ধরে ধরে বিচার করো’, ‘কণ্ঠে আবার লাগা জোর, মুজিববাদের কবর খোড়’, ইত্যাদি সেøাগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠে শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ এলাকা।

কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, শহীদদের রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি, এর মধ্যে স্বৈরাচারকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন কেউ কেউ। যখনই আমরা চিরতরে দেশ থেকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করতে চাই, তখনই সুশীল বেশে কিছু ব্যক্তি ও দল বিরোধিতায় নেমে যায়। আমরা প্রয়োজনে তাদেরও প্রতিহত করব।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নেতাকর্মীরা সকাল থেকে শহীদ মিনারের আশপাশে অবস্থান নেন। চেয়ার বিছিয়ে শহীদ মিনারের সামনেও অনেক বিপ্লবীকে অবস্থান করতে দেখা যায়। অনেকের মাথায় দেশের পতাকা বাঁধা রয়েছে। শহীদ পরিবারের সদস্যরাও শহীদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নেন এবং পর্যায়ক্রমে তারা মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে হাজির হন।

‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কোনো ঘোষণাপত্র নেই। আমরা বলেতে চাই, আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে। ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আপনারা ঘোষণাপত্রের পক্ষে জেলায়, মহল্লায় মানুষের কাছে যাবেন। তাদের কথা শুনবেন যে তারা কী বলতে চায়। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে আমাদের সংগ্রাম জারি থাকবে এবং গত ৩ আগস্টের এক দফা ঘোষণার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এই শহীদ মিনার থেকে আমরা এক দফা ঘোষণা দিয়েছিলাম। অনেকেই আমাদের এই অভ্যুত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। এজন্য সচিবালয়ে, পুলিশ বিভাগে ষড়যন্ত্র চলে। যারা সচিবালয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, তাদের বলতে চাই, আপনারা রিয়েলিটি মেনে নেন। এই দেশে খুনি হাসিনার পুনর্বাসন হবে না। গত ১৬ বছর ফ্যাসিবাদী সরকার প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।

হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমাদের ডাকে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। আমরা হাসিনাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছি। আমরা এই সরকারকে বলতে চাই, এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক হয়নি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আপনাদের কাজটা কী? দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করতে হবে। তিনি বলেন, যদি কোনো বিপ্লবীর ওপর আক্রমণ করা হয়, এই সরকারকে তার দায়ভার নিতে হবে। আজ এতদিন হয়ে গেছে এখন পর্যন্ত বিচারবহির্ভুত হত্যাকা-ের বিচার নিশ্চিত করা হয়নি। পিলখানা হত্যাকা-ের বিচার অতি শিগগির নিশ্চিত করতে হবে। শাপলা চত্বরে আলেমদের হত্যা করা হয় রাতের আঁধারে। সে বিচার করতে হবে। ৫ আগস্ট- পরবর্তী বাংলাদেশে আমাদের আর কোনো শত্রু নেই। আমাদের একমাত্র শত্রু আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ছাত্র-জনতার দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারির উদ্যোগ নিয়েছে। এটি আমাদের বিজয়। এই ঘোষণাপত্রে একাত্তর, নব্বই এবং চব্বিশের মানুষের গণআকাক্সক্ষা থাকতে হবে। সরকারকে হুঁশিয়ার করতে চাই, অতিদ্রুত ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপে সক্রিয় হোন। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে স্পষ্ট করে বলতে চাই, যেসব খুনি বিদেশে পালিয়ে গেছে তাদের ফেরত আনতে হবে, তাদের পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে হবে। গোপালগঞ্জে লুকিয়ে থাকা তাদের দোসরদের গ্রেফতার করতে হবে।

নতুন সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা চায়। নতুন সংবিধান চায়। নতুন সংবিধান বাংলাদেশের মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই হবে। আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, আমরা রীতিমতো বাধ্য হয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছি। ৫ আগস্টের পর পাঁচ মাস পর এই ঘোষণাপত্রের উদ্যোগ নিতে হলো। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিতের আগে কোনো নির্বাচন হবে না।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্ত শারমিন বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পরও কেউ জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের উদ্যোগ নেয়নি। তাদের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে এটি ঘোষণা করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, আমরা অভ্যুত্থানে ঘোষণা দিয়েছিলাম নতুন বন্দোবস্তের জন্য। এই জনআকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে আমাদের ঘোষণাপত্র।

কর্মসূচি শুরুর আগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
কর্মসূচিতে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ শাহরিয়ার হাসান আলভীর বাবা আবুল হাসান, পুলিশের গুলিতে আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ, আতিকুল গাজীসহ শহীদ পরিবারের সদস্য এবং আহতরা। ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের পরিবারের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে শহীদ মীর মুগ্ধের বাবা অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত সবাইকে ‘বিপ্লবী যোদ্ধা’ হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান। আরো বক্তব্য রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম, খান তালাত মাহমুদ রাফি, রিফাত রশীদ, মাহিন সরকার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক শ্যামলী সুলতানা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক রফিকুল ইসলাম আইনী প্রমুখ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button