হিংস্র হয়ে উঠতে পারে নৌদস্যুরা
শঙ্কা আর কষ্টের কথা জানালেন জিম্মি নাবিকেরা :: এমভি আবদুল্লাহকে ঘিরে উপকূলে সোমালি পুলিশ সাগরে ইইউর যুদ্ধ জাহাজ :: অজানা আতঙ্কে স্বজনেরা
সোমালিয়া উপকূলে নৌদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে ঘিরে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে সোমালি পুলিশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যুদ্ধ জাহাজ। এ অবস্থায় জাহাজে জিম্মি ২৩ নাবিকের প্রতি নৌদস্যুদের আচরণ আরো নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। তারা যে কোন সময় হিংস্র হয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এক সপ্তাহ পর গতকাল শুক্রবার নাবিকদের স্বল্প সময়ের জন্য পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে ছিনতাইকারী সোমালি দস্যুরা। নাবিকেরা জাহাজে তাদের কষ্টের কথা জানিয়েছেন। যেকোনো মূল্যে তাদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়ার আকুতিও জানিয়েছেন ১১দিন ধরে জিম্মিদশায় থাকা নাবিকেরা। তারা জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ টহলের ফলে সোমালি নৌদস্যুরা চাপে পড়েছে। আর এজন্যই তারা নাবিকদের সাথে রূঢ় আচরণ করছে। কোন রকম সামরিক অভিযান শুরু হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। আর তাতে রক্তপাত এমনকি জীবনহানির আশঙ্কাও রয়েছে। নাবিকেরা এমন আশঙ্কার কথা জানানোর পর তাদের পরিবারের সদস্য এবং স্বজনদের মাঝে শঙ্কা বেড়েই চলেছে। তবে জাহাজ মালিকের তরফে আবারো সমঝোতার মাধ্যমে জিম্মি জাহাজ ও নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে সবার সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমভি আবদুল্লাহকে ঘিরে সোমালিয়া উপকূলীয় এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। জাহাজ আবদুল্লাহ উপকূলীয় এলাকা থেকে মাত্র দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে। সোমালিয়া ভাষায় প্রকাশিত একটি গণমাধ্যম জানিয়েছে পুলিশ উপকূলে ঘেরাও করে অবস্থান নিয়েছে। আবার সাগরে এমভি আবদুল্লাহর খুব কাছেই ইইউএনএভিএফওআর আটলান্টা অপারেশনের একটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১২টার দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর ওই সংস্থাটি তাদের এক্স হ্যান্ডেলে বিষয়টি জানিয়েছে। এক্স পোস্টে ইইউএনএভিএফওআর বলেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে দস্যুতার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তিনটি বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা হয়েছে। যার মধ্যে একটি, এমভি আবদুল্লাহ এখনো নৌদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আছে। ওই এলাকায় আটলান্টা অপারেশনের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন আছে।
পোস্টে যুক্ত একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে এমভি আবদুল্লাহর অদূরেই ইইউএনএভিএফওআর এর যুদ্ধজাহাজটিকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। এছাড়া একটি হেলিকপ্টারও এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি চক্কর দিতে দেখা যাচ্ছে।
পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে নৌদস্যুতা নির্মূলে কাজ করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্সও তাদের ‘অপারেশন আটলান্টার’ অংশ হিসেবে এমভি আবদুল্লাহর ওপর নজর রাখছে বলে শুরু থেকেই জানিয়ে আসছে। বৃহস্পতিবার গভীর রাতের এক্স হ্যান্ডেলের পোস্টে সংযুক্ত তিনটি ছবির একটিতে ইইউএনএভিএফওআর- আটলান্টা অপারেশনের দুজন কমান্ডোকে এমভি আবদুল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। অন্য দুটি ছবির একটিতে এমভি আবদুল্লাহর উপর হেলিকপ্টার টহল দিতে এবং আরেক ছবিতে যুদ্ধ জাহাজটিকে দেখা যাচ্ছে। ইইউএনএভিএফওআর এর পোস্টে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের কথা বলা হলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বলা হয়নি।
এই পোস্টের সাথে সংযুক্ত একটি প্রতিবেদনে, ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ২১ মার্চ পর্যন্ত গত প্রায় চার মাসে এডেন উপসাগর ও সোমালি সমুদ্রসীমায় ২৪ টি সমুদ্রযানে দস্যুতা, ডাকাতি, ছিনতাই ও দখলচেষ্টার ঘটনার উল্লেখ করা হয়।
ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ আইএনএস তর্কশ গত বৃহস্পতিবার সকালে এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু নাবিকরা সশস্ত্র জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকায় সে সময় অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকেন ভারতীয় নৌ সেনারা।
মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালি নৌদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। দস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৩ নাবিকের সবাইকে জিম্মি করে। নাবিকরা সবাই বাংলাদেশি।
নৌদস্যুদের সঙ্গে প্রথমবারের মত কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ হওয়ার তথ্য গত বুধবার জানায় জাহাজটির মালিকপক্ষ।
এর আগে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজটি এবং জিম্মি নাবিকদের নৌদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দেশটির পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশের বরাতে সোমবার রয়টার্সে খবর এসেছে। কিন্তু নাবিকদের ‘নিরাপত্তায়’ এমভি আবদুল্লাহ উদ্ধারে কোনো অভিযান চায় না জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান।
এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পার্সন মিজানুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, জাহাজের নাবিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা কোন ধরনের সামরিক পদক্ষেপে সমর্থন করেন না। বাংলাদেশ সরকারেরও একই চাওয়া। বিষয়টি আমরা সব মহলকে অবহিত করেছি। তিনি বলেন, নাবিকেরা পরিবারের সদস্যদের সাথে এবং আমাদের সাথে কথা বলেছেন। তারা অক্ষত আছেন।
এদিকে সাতদিন পর গতকাল সকালে জিম্মি ২৩ নাবিককে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। জাহাজের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তারা একে একে এক মিনিটের মতো সময় নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন। চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের ছোটভাই আসিফ খান ইনকিলাবকে বলেন, দস্যুরা তাদের উপর শারীরিক কোন নির্যাতন না করলেও নানাভাবে নিষ্ঠুর আচরণ করছে। সবাইকে ডেকের একটি কক্ষে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। পুরো জাহাজ ৪০-৪৫ অস্ত্রধারী দস্যু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তারা দুই দিন পরপর এক ঘন্টার জন্য নাবিকদের পানি সরবরাহ দিচ্ছে। খাবারের চেয়ে পানির কষ্টে তাদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। তার ভাইয়ের শরীরে এলার্জি দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ জাহাজের টহলের কারণে দস্যুরা ক্ষণে ক্ষণে বেপরোয়া হয়ে উঠছে জানিয়ে তিনি আশঙ্কা করেছেন তারা যেকোনো সময় হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। তারা সমঝোতার মাধ্যমে জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এবং নাবিকদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে সরকার এবং মালিক পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
উল্লেখ ২০১০ সালে কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এমভি জাহান মনি নামে আরো একটি জাহাজ দস্যুদের কবলে পড়েছিল। মুক্তিপণ দিয়ে ১০০ দিন পর জাহাজিটি ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তাতে জিম্মি ছিলেন ২৬ নাবিক।